‌বন্যেরা বনে সুন্দর, মিঠুন বাংলায়

স্বরূপ গোস্বামী

অনেকদিন পর আবার প্রকাশ্যে আপনি। তাও সুদূর কার্শিয়াঙে। নিঃশব্দে এলেন। কেউ জানতেও পারল না। ভোটের আবহে আপনি পাহাড়ে। অথচ, একটি কাগজ ছাড়া অন্য কোনও কাগজে সেই উপস্থিতি খবরই হল না। চ্যানেলে চ্যানেলে এত ভোটের কচকচি, অথচ কোথাও আপনার উপস্থিতির উল্লেখ নেই। আপনি প্রচার চাননি ঠিকই, তাই নিঃশব্দেই পাহাড়ে পৌঁছে গেছেন। কোনও প্রেস–‌মিডিয়া জানতেও পারেনি। কিন্তু যা হয়, মোবাইল ক্যামেরার যুগ। কোথা থেকে কে ছবি তুলে ফেলবে, তা তো আপনার হাতে নেই। এমনই একটি ছবি ছড়িয়ে গেল। ওই একটা ছবিই তো যথেষ্ট। প্রায় পাঁচ বছর পর আপনার প্রিয় বাংলায় আপনাকে দেখা গেল, এটাই কি যথেষ্ট নয়!‌ তাও বাংলা মিডিয়া কী নির্লিপ্ত!‌ একটি বাংলা দৈনিক ছাড়া কেউ খবরটার গুরুত্বই বুঝল না!‌

mithun5

ঠিক পাঁচ বছর আগের কথা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরম। কোথাও কোথাও চল্লিশ ডিগ্রি ছাপিয়ে গিয়েছিল তাপমাত্রা। তার মাঝেই চলছিল নির্বাচনী প্রচার। বাংলার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, ঝড় তুলছিলেন আপনি।
তখন আপনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত। কিন্তু তখনও দিল্লিতে গিয়ে শপথ নেওয়া হয়নি। ফলে, সরকারিভাবে তখনও এম পি হননি। নাই বা হলেন!‌ মিঠুন চক্রবর্তীর আবার এমপি–‌র তকমা লাগে নাকি!‌ তাঁর নামটাই যথেষ্ট। ধুপসি গরমে অবশ্য আপনাকে ছুটতে হয়নি। যতদূর মনে পড়ে, আপনার প্রচারের জন্য একটা আলাদা হেলিকপ্টার দেওয়া হয়েছিল। এটুকু তো আপনার প্রাপ্যই ছিল। কারণ, কোচবিহার থেকে পুরুলিয়া আপনাকে উড়তে হয়েছিল। যেখানেই আপনি, সেখানেই যেন জনস্রোত। হওয়ারই কথা। হলেনই বা আপনি তৃণমূলের। তাই বলে আপনার প্রতি কার দুর্বলতা নেই!‌ বাম বলুন, বিজেপি বলুন, কংগ্রেস বলুন–‌সব বাঙালিই যেন আপনার মধ্যে লড়াই করা সেই নায়ককে খুঁজে পায়। উত্তর কলকাতার গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী কীভাবে বম্বে গিয়ে মিঠুন হয়ে উঠল, সেই লড়াই তো রূপকথার মতোই। প্রাক–‌সৌরভ যুগে দেশজুড়ে এই বিক্রম কোন বাঙালি দেখিয়েছে!‌
আপনার একটা ডায়লগ বেশ সুপারহিট— মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে। ভোটের বাজারে সেটাকেই একটু যেন বদলে দিলেন। এন কে সলিলের লেখা এই সংলাপটাও আপনার মুখে দিব্যি হিট করে গেল— বোতাম টিপব এখানে, সরকার গড়ব ওখানে। কোচবিহার থেকে নদিয়া, পুরুলিয়া থেকে মেদিনীপুর। পাহাড়, সাগর, অরণ্য সব এলাকাতেই মিঠুনকে দেখার একই উন্মাদনা। সহজ কথা, তৃণমূলের নেতাদের সেই ভিড় টানার ক্ষমতা ছিল না। টলিউডি ঝিঙ্কু–‌মামনিদেরও ছিল না। সবাইকে টেনে আনতে পারত একটিই নাম— মিঠুন চক্রবর্তী। সেই নামটাকেই এগিয়ে দাও। অন্যদিকে, আপনারও তখন কৃতজ্ঞতা থাকা স্বাভাবিক। সেই প্রথম কোনও দল সম্মান দিয়ে আপনাকে রাজ্যসভায় পাঠাচ্ছে। আপনার কাছে ওই ‘‌এমপি’‌ ট্যাগলাইনটা হয়ত তেমন কিছুই নয়। তবু এই ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকু কে না চায়!
‌ভোট মিটে গেল। এখানে দিব্যি বোতাম টেপা হল। কোথাও ভোটাররা টিপলেন। কোথাও পাইকারি হারে টিপে গেল ছাপ্পাবাহিনী। ৪২ এ ৩৪ আসনও এসে গেল। কিন্তু কী আর করা যাবে, ‘‌ওখানে’‌ সরকার হল না। ভোটের বাজারে যে মিঠুনকে বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়াতে দেখা গেল, ভোটের পর তাঁকে মনেও পড়ল না। এত ঘটা করে ফিল্ম ফেস্টিভাল হল। সেই জমকালো মঞ্চে অমিতাভ থেকে শাহরুখ, কমল হাসান থেকে অভিষেকদের ডাক পড়ল। কিন্তু আপনি ব্রাত্যই থেকে গেলেন। পরের বছরগুলোয় জমকালো মঞ্চে আপনাকে আর দেখা গেল না। একটু একটু করে দূরত্ব যেন বাড়তে লাগল। আপনাকে ইডি ডাকছে, আপনি সারদায় জড়িয়ে, এসব জল্পনা ছড়াতে লাগল। পরপর চারবার সর্বোচ্চ আয়কর দাতার পুরস্কার এসেছে আপনার ঘরে, তিন তিনটে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড যাঁর বাড়ির শোকেসে, সেই আপনাকে কিনা চিটফান্ডে সন্দেহ করা হচ্ছে!‌ ইডি ডেকে পাঠাচ্ছে!‌ জানাই ছিল, আপনি সব টাকা ফিরিয়ে দেবেন। বাকিদের মতো ধমকে চমকে পাওয়া টাকা নয়। এটা–‌সেটা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পাওয়া টাকাও নয়। রীতিমতো পরিশ্রম করে, শুটিং করে অর্জিত টাকা। না ফিরিয়ে দিলেও হয়ত কিছু বলার ছিল না। কিন্তু আপনি লোকটা যে অন্য ধাতুতে গড়া। তাই ফিরিয়ে দিলেন। অভিমানে নিজেকে একটু একটু করে গুটিয়ে নিলেন।

mithun2
সংসদে আপনি নেই, প্রচার সভায় আপনি নেই, সিনেমায় আপনি নেই, বহুদিন রিয়েলিটি শোতেও আপনি নেই। কোথাও ইন্টারভিউতে নেই। ফিল্ম পার্টিতে নেই। এমনকী দেশে আছেন কিনা, তাও ধোঁয়াশা। তীব্র অভিমান হওয়াই স্বাভাবিক। যে মানুষটা বাংলার জন্য নিঃশব্দে এতকিছু করেছে, সেই লোকটাকে কিনা বাংলার মানুষ ভুল বুঝল!‌ রূপকথার নায়ককে কিনা সারদার কারণে লোকে চিনছে!‌ এতদিনের এত পরিশ্রম, এত লড়াই, সব মিথ্যে!‌ যাঁদের আত্মসম্মান নেই, তারা গলা বাজিয়ে মিথ্যে বলতে পারেন। এর ওর কাছ থেকে টাকা আদায় করাটা তাঁরা হয়ত অধিকারই মনে করেন। কিন্তু যাঁদের আত্মসম্মান আছে, তাঁদের যন্ত্রণা শুধু তাঁরাই বোঝে। শপথ নেওয়ার আগেই বলেছিলেন, যে কোনওদিন এই এমপি পদ ছেড়ে দিতে পারেন। অনেকে বিশ্বাস করেনি। না করারই কথা। ক্ষমতার জন্য লোকে দিনে–‌রাতে দল বদলায়, ক্ষমতার জন্য দিনে–‌দুপুরে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে যায়। সেখানে আপনি কিনা এম পি পদ ছাড়বেন!‌ এতই সহজ নাকি!‌ কিন্তু ওই যে বললাম, আপনি লোকটা বরাবরই একটু অন্য ধাঁচের। নিঃশব্দে পদত্যাগের চিঠি পাঠিয়ে দিলেন। না, কোনও বিস্ফোরক বিবৃতি দিতে হয়নি। কোনও প্রেস কনফারেন্স করতে হয়নি। কোনও টুইট করতে হয়নি। কোনও হাওয়া গরম করতে হয়নি। এভাবেও ছেড়ে আসা যায়!‌
সংযম কাকে বলে, বাঙালি বুঝেছে সুচিত্রা সেনকে দেখে। সেই যে গৃহবন্দি হলেন, তিন দশক ধরে বাংলার গ্রেটা গার্বো নিজেকে একেবারে আড়ালেই রেখে দিলেন। তারপর অনেকটাই আপনি। পাঁচ বছর কী করেছেন, কোথায় ছিলেন, তার কতটুকুই বা আমরা জানি!‌ আপনার ঘনিষ্ঠ বলে একসময় যাঁরা দাবি করত, তাঁরাও এই পাঁচ বছরে সেই দাবি সিন্দুকে ঢুকিয়ে রেখেছিল। এই পাঁচ বছরে আপনাকে ধরার, আপনার একটা বাইট বা কোট পাওয়ার কম চেষ্টা তো হয়নি। কিন্তু সবাইকে ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হয়েছে। কখনও শোনা যায় আপনি অসুস্থ, কখনও শোনা যায় আপনি আমেরিকায়। ব্যাস, আমাদের জানার দৌড় ওই এতটুকুই। এমনকী, এই যে কার্শিয়াঙে এলেন, কবে এলেন, কোন পথে এলেন, তাও রহস্য। বাগডোগরায় বিমানে নেমেছেন!‌ কেউ চিনতে পারল না!‌ নিঃশব্দে হোটেল তৈরি হয়ে গেল!‌ কেউ বুঝতেও পারল না ওটা আপনার হোটেল!‌
খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাঙালির ওপর এখনও কি আপনার তীব্র অভিমান!‌ হলেও দোষ দেওয়া যায় না। সত্যিই তো, এই বাংলাকে এত গৌরব আপনি এনে দিয়েছেন, সেই বাঙালি কিনা আপনাকে ভুল বুঝল!‌ কী ভাবছেন, আপনি আড়ালে থাকলেই বাঙালি নিজের ভুল বুঝতে পারবে!‌ সে আশা ছেড়ে দিন মশাই। বাঙালি এখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিনতে পারল!‌ সিঙ্গুর থেকে টাটাদের তাড়ানোর পরেও বাঙালির কোনও চেতনা হল?‌ শিল্প নেই, কিন্তু ঢক্কানিনাদ আছে, বাঙালির কী আসে যায়!‌ বাঙালি গড্ডালিকা প্রবাহেই ভেসে যায়। বাঙালি খেউড় শুনতেই ভালবাসে। তাই মঞ্চ থেকে নিরন্তর খেউড় শুনছে। নিজের ঢাক নিজে বাজানো আর মিথ্যের ফুলঝুরি শুনতেই বাঙালি ভালবাসে। এই বাঙালির যেমন শাসক পাওয়া উচিত, বাঙালি ঠিক তেমনটাই পেয়েছে।

mithun4
আরও এক বাঙালি, তীব্র অভিমানে নিজেকে বন্দি রেখেছেন পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট্ট ঘরে। মানুষটার নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আপনিও পেরেছেন অভিমান আর নীরবতা দিয়েই তীব্র প্রতিবাদ রেখে যেতে। এই নীরবতা, এই প্রতিবাদটুকু রেখে যাওয়া দরকার ছিল। হাজার হাজার ভাষণের চেয়েও এই নীরবতা বড় ভয়ঙ্কর। তবু আবেদন, আপনাকে সুচিত্রা সেনের ভূমিকায় দেখতে চাই না। তাই, কার্শিয়াঙে আপনার সেই ছবিটা দেখে সত্যিই যেন চেনা মানুষের দেখা পেলাম। মানুষ ঠকে শেখে। আপনিও শিখেছেন। অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছেন, রাজনীতির মঞ্চ আপনার জন্য নয়। মুম্বই, উটি, আমেরিকা যখন যেখানে খুশি থাকুন। কিন্তু মাঝে মাঝে বাংলায় আসুন। বাঙালির হৃদয়ে আপনি ছিলেন, আছেন। এই কয়েক বছরে তিল তিল করে কত কষ্ট পেয়েছেন, কীভাবে প্রতিদিন রক্তাক্ত হয়েছেন, তা আমরাও বুঝি। ভুল বোঝা বাঙালি যেমন আছেন, তেমনি সংবেদনশীল বাঙালিরাও কিন্তু এখনও লুপ্ত হয়ে যায়নি। অন্তত তাঁদের মুখ চেয়ে জনমানসে আবার ফিরে আসুন। মাঝের এই সময়টুকু আপনিও মন থেকে মুছে ফেলুন। আমরাও মুছে ফেলতে চাই। সত্যি করে বলুন তো, বাঙালিকে ভুলে, বাংলাকে ছেড়ে আপনি ভাল থাকতে পারবেন!‌ আমাদের এন কে সলিল নেই, বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের (‌পালামৌ–‌এর লেখক)‌ একটি প্রাচীন সংলাপকে একটু পাল্টে বলতে ইচ্ছে করে, বন্যেরা বনে সুন্দর, মিঠুন বাংলায়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.