এটা আবার বিশ্বকাপ নাকি!‌

সন্তু বিশ্বাস

যারা কবিতা লিখতে পারে না, তারা চিরকালই কবিতা লিখতে পারা লোকদের ব্যঙ্গ করে। এমনিতে লিখতে না পারলেও ব্যঙ্গ করার জন্য দু এক লাইন কবিতা লিখে ফেলে, যে সব কবিতার উদ্দেশ্যই হল কবিদের হেয় করা। এমনই কিছু কবিতার লাইন হল, “কবি কবি ভাব ছন্দের অভাব”, “অ্যান্টেনায় কাক আমি তো অবাক” ইত্যাদি। কবি অথবা কবিদের প্রতিপক্ষদের নিয়ে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, শেষের পঙক্তিটিতে।

“অ্যান্টেনায় কাক আমি তো অবাক।” হাসি ঠাট্টা যাই হোক বিগত শতকের আট এবং নয়ের দশকের নিখুঁত একটি চিত্র উঠে এসেছে এই লেখায়। নতুন শতাব্দীতে যাদের জন্ম, তারা এর মর্ম বুঝবে না। তখন চ্যানেল মানে ডি ডি ওয়ান, ডি ডি টু। প্রথমে তো তাও ছিল না। সবেধন নীলমণি একটাই চ্যানেল। তারপরে তো ধাপে ধাপে, ডি ডি মেট্রো, ডি ডি সেভেন, তারপর উবু, দশ, কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ করতে করতে আটশো- নশো চ্যানেল! এত চ্যানেল, কিন্তু মাইরি বলছি দেখার মতো কিছু নেই। সেই একই সিরিয়াল, রিয়ালিটি শো, গ্যাদগ্যাদে সব সিনেমা, খবরের নামে সন্ধেবেলা চিলচিৎকার আর আলফাল চ্যানেলগুলোতে দিনরাত খালি জ্যোতিষচর্চা।

টি ভি জিনিসটার কী মাহাত্ম্য তা জানে শুধু তারা, যারা গত শতাব্দীর সাত বা আটের দশকে জন্মেছে। শনিবার হিন্দি ছবি, রবিবার বাংলা। বুধবার হিন্দি সিনেমার গানের অনুষ্ঠান চিত্রহার, বৃহস্পতিবার বাংলা গানের জন্য চিত্রমালা। যার বাড়িতে টি ভি আছে সে পাড়ায় প্রায় রাজাবাদশার মর্যাদা পেত। সাপ্তাহিক দিনগুলোতে তার বাড়ি ছোটখাটো সিনেমা হলের চেহারা নিত।

antenna

আর বিশ্বকাপের সময়? হু-হু বাবা সেই কথাই তো বলতে বসেছি। আজকালকার পোলাপানরা টি ভি অ্যান্টেনা কী তা জানেই না। আমরা জানতাম। টি ভির মাথায় লাগানো থাকতো আরশোলার শুঁড়ের মতো দুটো স্টিলের কাঠি। আর বাড়ির ছাদে অ্যান্টেনা। সেখান থেকে তার এসে সোজা ঢুকে যেত টিভির ভিতরে। যদি সেই অ্যান্টেনা জোরে হাওয়ায় ঘুরে যেত বা ঘুড়ির সুতো আটকে যেত বা উড়ে এসে বসত কাক, তাহলে সত্যিই আমরা অবাক। টি ভি ঝিরঝির করা শুরু করল। ওরে কে আছিস, ছাদে গিয়ে অ্যান্টেনা ঠিক করে দিয়ে অ্যায়।

তারপর আস্তে আস্তে সব বাড়িতে টি ভি চলে এল। এক আধটা বাড়িতে রঙিন টি ভি। কিন্তু অ্যান্টেনার রমরমা কমল না। ওয়ার্ল্ড কাপ আসা মানেই বাজারে নতুন টি ভি, নতুন অ্যান্টেনা আসা। একবার কী করে যেন নতুন অ্যান্টেনায় বাংলাদেশ টি ভি ধরল। সে কী উত্তেজনা। বাংলাদেশের টি ভিতে নাকি বেশি খেলা দেখা যায়। তারপর এল জিলিপি অ্যান্টেনা। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। গোল জিলিপির মতো আকার। তার বিশেষত্বটা কী তা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, কারণ ততদিনে পাড়ায় পাড়ায় কেবল টি ভি ঢুকতে শুরু করেছে।
যাই বল বাপু, আমাদের সেই সময়টা অনেক ভাল ছিল। চার বছর অন্তর একবারই মারাদোনা, রোমারিওদের দেখতে পেতাম। ক্লাবের মেসি ভালো না দেশের মেসি- এই বিতর্কের সুযোগই ছিল না। যা দেখতাম তাই অমৃত। না ছিল রিপিট টেলিকাস্ট, না ছিল খবরের চ্যানেলে ফিরে ফিরে বিশেষ মুহূর্তগুলো দেখা। দেখতে চাও তো রাত জাগো, রাত জাগবে তো আগে থেকে নতুন টি ভি, নতুন অ্যান্টেনা কেনো। আরে বাবা কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে? আমরা কষ্ট করতাম তাই আমাদের মারাদোনা ছিল, জিকো, প্লাতিনি ছিল। তাদের পাশে তোদের এই মেসি-রোনাল্ডো-নেইমার?

ছো!!! ম্যান মারকিং সামলাতে পারে না, একটা ফাউল করলে পাঁচবার ডিগবাজি খায়, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড-র কাছে গড়াগড়ি খায়, ইরানকে হারাতে দাঁত ছিরকুটে পড়ে তারা আবার মহাতারকা!

বাচ্চা ছেলে খেলা দেখছিস দ্যাখ, যা বুঝিস না তা নিয়ে তর্ক করিস না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.