বেঙ্গল টাইমসের জনপ্রিয় ফিচার নব্বইয়ের দশক। সেই সময়ের রাজনীতি, খেলা, সিনেমা, গান, সাহিত্য, প্রেম— সবকিছুকে একটু ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা। কীভাবে আলোড়ন তুলেছিল সেই সময়ের গান। স্মৃতির সরণি বেয়ে সেই কথাই তুলে আনলেন শ্রীপর্ণা গাঙ্গুলি।।
কিশোর পরবর্তী সময়ে সেরা রোমান্টিক গায়ক কে ? প্রশ্নটা উঠলে নিশ্চিতভাবেই আপনার নাম চলে আসে। আসবে নাই বা কেন ? সেই নয়ের দশকে কম গান উপহার দিয়েছেন ? আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে এই নয়ের দশকের একটা অদ্ভুত যোগসূত্র আছে। সেই সময় নতুন নতুন গান শুনছি। গুনগুন করে গাইছি। সেই গানেই কেউ প্রেম নিবেদন করছে। পাড়ার কত ছোকরার মুখে যে তখন আপনার গান শুনতাম! সেই রোমান্টিক গায়কের কিনা বাষট্টি বছর বয়স হয়ে গেল!
বড় সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো। গানগুলো কানের ভিতর দিয়ে ঢুকত। হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যেত। আজও কখনও আশিকি, কখনও সাজন, কখনও নাইনটিন ফর্টি টু আ লাভ স্টোরি, কখনও বাজিগর। প্রায় তিন দশক হতে চলল। গানগুলো এখনও কী জীবন্ত।
বিশ্বাস করুন, এখনকার গান শুনতে ইচ্ছে করে না। হানি সিং না কে একটা আছে। সে গাইছে ধীরে ধীরে সে মেরে জিন্দেগি মে আনা। এই প্রজন্ম তাই শুনেই কেমন নাচছে। হায় রে হতভাগার দল। এই গানটা যদি কুমার শানুর কণ্ঠে শুনতিস! বাঙালি এক গায়ক নাকি এখন বলিউড মাতাচ্ছে। নাম অরিজিৎ সিং। গান গাইছে না চিৎকার করছে, ঠিক বুঝতেও পারি না। এই সব গানের আয়ু দু মাস কী তিন মাস। তারপর কোথায় হারিয়ে যাবে, আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না।
আমরা মহম্মদ রফিকে পাইনি। মুকেশকে পাইনি। হেমন্ত মুখার্জিকে পাইনি। সেরা সময়ের মান্না দে-কেও পাইনি। কিন্তু আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় আপনাকে পেয়েছিলাম। পরপর পাঁচবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ! আর কেউ পেয়েছে ? জানি না। মেলোডি না থাকলে সে আবার গান হল নাকি ? আর মেলোডি বললে আপনার কথা ঠিক এসে যায়। আপনাকে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে আপনি কেমন গান দিতে পারেন, তা দেখিয়ে দিয়েছেন আর ডি বর্মণ। এক লেড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা। কুছ না কহো, কুছ ভি না কহো। এখনও যখন এফ এম-এ এইসব গান বাজে, সব কাজ থামিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে।
কয়েকদিন আগে আমাদের বাড়িতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। এখনকার ছেলে-ছোকরার দল হানি, মিকাদের গান চালিয়ে দিল। খুব বিরক্ত লাগছিল। কিছু বলতেও পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, আপনার সাজনের গান বাজছে। যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। খোঁজ করলাম, কে এই গান চালালো। জানলাম, আমার থেকে কয়েক বছরের বড় এক দাদা। তাঁরও বেড়ে ওঠা ওই নয়ের দশকে। মনের কোনে কোথাও একটা ভাল লাগা থেকে গিয়েছিল আপনার জন্য। যা এতদিন পর প্রকাশ পেল।
এভাবেই মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা ভালবাসা বেরিয়ে আসে। কী করে ভুলব সেই বেড়ে ওঠার দিন গুলো ? এখন যারা ধুমধাম গান বাজাচ্ছে, তাদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, কুড়ি বছর পর এই সব গানগুলো তারা শুনতে পারবে তো ?
শুনেছি, কল্যাণজি-আনন্দজি নাকি আপনার নামটা বদলে দিয়েছিলেন। কেদার ভট্টাচার্য থেকে সরাসরি কুমার শানু। ঠিকই করেছিলেন। কেদার ভট্টাচার্য নাম হলে আপনাকে সবাই এভাবে গ্রহণ করত কিনা জানি না। নাদিম-শ্রবণ। আহা, কী অনবদ্য সুর। এমন সুন্দর একটা জুটি। কোথায় যে হারিয়ে গেল! আর ডি! তিনি তো অনন্য। নেভার আগে প্রদীপ নাকি দ্ব্যপ করে জ্বলে ওঠে। আর ডি-র সেই জ্বলে ওঠাটা ছিল আপনার কণ্ঠে। এখনকার মিউজিক ডাইরেক্টরদের কথা ভাবি। নিজেরাই গাইতে শুরু করে দিয়েছে। ওরে, তোদের গান কে শুনতে চায় ?
আগাছায় ভরে গেছে চারিদিক। তাই আপনার বা সোনু নিগমের জায়গা হয় না। কিন্তু শ্রোতাদের ভাল লাগায় আপনারা থেকে গেছেন। নিশ্চিত থাকুন, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও ‘কুছ না কহো’ বেঁচে থাকবে। সেদিন আপনি থাকবেন না। আমরাও থাকব না। কিন্তু গানটা থেকে যাবে। আপনার কণ্ঠও থেকে যাবে।
বয়স যতই বাষট্টি হোক। আপনার রোমান্টিক কণ্ঠকেই মনে রাখতে চাই। ভাল থাকুন, খুব ভাল থাকুন শানুদা।