সবাইকে মন্ত্রী, এমপি বানিয়েছেন, নিজে হননি

(রাজনীতির বৃত্তেই ছিলেন না। হঠাৎ করেই এসে পড়লেন। কারণ, অশোক ঘোষ। দূর থেকে, কাছ থেকে, দুভাবেই দেখেছেন। সেই মুগ্ধতাই উঠে এল প্রাক্তন বিধায়ক মাণিকলাল আচার্যর অকপট স্মৃতিচারণে। ৪ বছর আগের সেই লেখাটি আবার পড়লে ভালই লাগবে।)

মানিকলাল আচার্য

গতবছর এই দিনটায় কলকাতা গিয়েছিলাম। অন্য কোনও কারণে নয়। শুধুমাত্র অশোকদাকে প্রণাম করতে। এবছর যাওয়া হল না। এমন একজন কিংবদন্তির জন্মদিন নিঃশব্দেই পেরিয়ে গেল।

আমরা নেতাজিকে দেখিনি। অনেক দিকপাল মানুষকে দেখলেও মেশার বা তাঁদের স্নেহ পাওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমরা ভাগ্যবান, আমরা অশোক ঘোষকে পেয়েছি। গর্ব করে এই কথাটা অন্তত বলতে পারব।

অশোকদার সঙ্গে আলাপ সেই স্কুলে পড়ার সময়, হাফ প্যান্ট পরা অবস্থা থেকে। ছোট বেলায় রাজনীতির কিছুই বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম, ফরওয়ার্ড ব্লক হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পার্টি। সেই পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে থাকাও গর্বের। আর সেই পার্টির প্রাণপুরুষ অশোক ঘোষ।

তখনই তিনি বিরাট মাপের এক মানুষ। যে মানুষটা এত এত লোককে এমপি, এম এল এ, মন্ত্রী করেন, কিন্তু নিজে কখনও সেই চেয়ারে বসেন না। যে মানুষটা সেই কৈশোরে বাড়ি ছেড়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন দলের জন্য। দলই তাঁর পরিবার। দলের ভাল-মন্দই তাঁর ভাল মন্দ।

কোনওকালেই নেতা ছিলাম না। নেতা হতে চাইওনি। মানুষের কাছাকাছি থাকতাম। সুখ দুঃখে পাশে দাঁড়াতাম। এই টুকুই। আর ছিন্নমস্তা মন্দির নিয়েই পড়ে থাকতাম। সাংসারিক ব্যাপারে আমারও কোনওকালেই তেমন উৎসাহ ছিল না। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খাও ছিল না। উনিই কার কাছে কী শুনেছিলেন, জানি না। একদিন বললেন, তোমাকে ভোটে দাঁড়াতে হবে। সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। উনি বললেন, এই এলাকায় সবাই তোমাকে ভালবাসে। তোমাকে ভরসা করে। তোমাকেই দাঁড়াতে হবে। দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রথমবারই বিধায়ক।

ashoke ghosh4

এলাকার ব্যাপারে যখনই কোনও সমস্যা হয়েছে, ওই মানুষটার কাছেই ছুটে গেছি। আমি গ্রামের মানুষ। কোনওকালেই কলকাতার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না। পনেরো বছর বিধায়ক থাকার সময়েও হাতে গোনা কয়েকবার কলকাতায় গেছি। গত দশ বছরে দশবারও যাইনি। সত্যি কথা স্বীকার করাই ভাল‌, কলকাতায় গিয়ে সেই প্রাণ পাইনি। সবকিছুই কেমন যেন যান্ত্রিক। ব্যতিক্রম একজন, অশোক ঘোষ। একমাত্র তাঁর কাছে গেলেই মনে হত, কোনও অভিভাবকের কাছে এলাম। সেই শুরুর দিন থেকে যে স্নেহ পেয়েছি, আর কারও কাছ থেকে তা পাইনি। অনেক সময় সমস্যার কথা বলতেও হয়নি। বলার আগেই তিনি বুঝে গেছেন। প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এই সহমর্মিতা অন্য কোনও নেতার মধ্যে দেখিনি। তিনি প্রকান্ড বটগাছ। বাকিরা কে কী গাছ, জানি না। তাঁদের ছায়া আছে কিনা, তাও জানি না।

আমি মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত, এটা উনি জানতেন। অনেকে হয়ত নাক সেঁটকাতেন। উনি কিন্তু এটাকে ভাল চোখেই বারবর দেখতেন। কোনওদিন বারণ করেননি। বলতেন, মন্দিরে বসেই যদি এত এত মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ হয়, মন্দ কী ? তোমার কাছে আসা মানেই তো মন্দিরে আসা। বা মন্দিরে আসা মানেই তো তোমার কাছে আসা। এত সুন্দরভাবে কেউ কখনও বলেনি। বেশ কয়েকবার ডিসেরগড়-সাঁকতোড়িয়া অঞ্চলে এসেছেন। ছিন্নমস্তার  মন্দিরেও এসেছেন, প্রণাম করেছেন। তাঁর মধ্যে কোনও ছুঁৎমার্গ কখনও দেখিনি। আমি কলকাতায় গেলে প্রথমেই জানতে চাইতেন, ‘মায়ের প্রসাদ এনেছো ? যখনই আসবে, মায়ের প্রসাদ অবশ্যই নিয়ে আসবে।’  আমি যখনই যেতাম, প্রসাদ নিয়ে যেতাম। এই তো কয়েকদিন আগে। আমার এক সহকর্মী ভবানী আচার্য কলকাতায় যাচ্ছিল। ওর হাত দিয়ে অশোকদার জন্য প্রসাদ পাঠালাম।

বড় রাজনীতিক হতে গেলে সবার আগে ভাল মানুষ হতে হয়। অশোকদার কাছে এটাই শিখেছি। অনেক বড় নেতা দেখেছি। কিন্তু তাঁদের অনেককেই ততখানি ভাল মানুষ বলে মনে হয়নি। চেয়ারের জন্য অনেক দলাদলি দেখেছি। কিন্তু সব হাতছানি উপেক্ষা করেছেন, এমন নীরব সন্ন্যাসী দেখিনি। যত ব্যস্তই থাকুন, সবসময় কথা বলতেন। প্রতিটি কথায় থাকত অকৃত্রিম স্নেহ।

সেই একান্ন সাল থেকে উনি রাজ্য সম্পাদক। তাও প্রায় ৬৫ বছর হয়ে গেল। টানা এতদিন দলের শীর্ষ পদে ? ভাবতেই কেমন অবাক লাগে। শুধু বাংলায় নয়, শুধু ভারতে নয়, আমার ধারণা সারা পৃথিবীতে এই নজির নেই। শুধু দীর্ঘদিন আছেন বলে নয়, এখনও এই চুরানব্বই বছর বয়সেও দলের সবথেকে সক্রিয় মানুষটির নাম অশোক ঘোষ। বয়স হলে অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, অনেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, অনেকে হয়ত বোঝাও হয়ে যান। কিন্তু অশোকদা দলের সম্পদ। তাঁকে ছাড়া এই দলটার কথা একটা দিনের জন্যও ভাবতে পারি না।

ashoke ghosh6

আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন একজন মানুষকে পেয়েও সেভাবে কাজে লাগাতে পারলাম না। আমরা কেউই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে পারলাম না। আমার মনে হয়, সঠিক সময়ে  এই মানুষটাকে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান করলে সামগ্রিকভাবে বামফ্রন্টের ভাল হত। শুধু ফরওয়ার্ড ব্লকের নয়, উনি বামফ্রন্টের অভিভাবক হতে পারতেন।

বাংলা আজ মোটেই ভাল নেই। চারিদিকে অশান্তি, খুনোখুনি, অরাজকতা। বন্ধ হোক এই খুনোখুনির রাজনীতি। যে যা পারছে, করে যাচ্ছে। কারও উপর কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। তখনই বেশি করে মনে পড়ে অশোকদার কথা। অশোকদার মতো মানুষেরা যদি শাসক দলে থাকতেন, বাংলা কখনই অশান্ত হয়ে উঠত না। এমনকি বামফ্রন্টের সময়েও যখনই সরকার কোনও ভুল করেছে, সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এই মানুষটি। কে কী ভাবল, কে কী বলল, পরোয়া করেননি। স্পষ্টভাষায় নিজের কথা বলেছেন। নেতা নয়, তখন তাঁকে বামফ্রন্টের বিবেক বলেই মনে হত।

এই মানুষটির যা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, যা দূরদর্শিতা, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। অনেক আগেই তিনি বুঝতে পারেন, কী হতে চলেছে। অনেকবার সতর্ক করেছেন। আমরাই হয়ত তাঁর কথার মর্ম বুঝিনি। সেদিন সবাই যদি তাঁর সাবধানবাণী শুনতাম, বাংলার বুকে এই বিপর্যয় নেমে আসত না।

(লেখক প্রাক্তন বিধায়ক ও বিশিষ্ট সমাজসেবী)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.