৯৮ বছরেও অনেক স্মৃতি আগলে আছেন বিজয়া

কোনও স্ক্রিপ্ট বা গল্প লিখলে সবার আগে পড়ে শোনাতেন স্ত্রী বিজয়া রায়কে। পথের পাঁচালি-র আগে নিজের হাতের গয়না তুলে দিয়েছিলেন সত্যজিতের হাতে । এমন অনেক স্মৃতি এই ৯৮ বছরেও আগলে রেখেছেন বিজয়া রায়। বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে গিয়ে এমন অনেক অজানা কথা জেনে এলেন সংহিতা বারুই।

 

বিজয়া দাস বড় হয়েছেন পাটনায়, পড়াশশোনা শুরু করেন কনভেন্ট স্কুলে । বাবা চারুচন্দ্র দাস ছিলেন ব্যারিস্টার । মা ছিলেন গৃহবধূ মাধুরী দেবী। চার কন্যার মধ্যে তিনি  ছিলেন ছোট । মাত্র তেরো বছর বয়সে  পিতৃহারা হয়ে মায়ের হাত ধরে চলে আসেন কলকাতায় তাঁর নিকট আত্মীয় বাড়ী । ঠিক সেই মুহূর্তে পারিবারিক ব্যবসা বিক্রি করে পিতৃহারা ছোট্ট সত্যজিৎ রায় তাঁর মা সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে চলে আসেন মামাবাড়িতে। এক সঙ্গে ছোট থেকে বড় হওয়া ভালো-লাগা  খারাপ লাগা মিলেমিশে একাকার। সত্যজিৎ রায় ও বিজয় দাস। ক্রমে দুজনের মধ্যে বাড়তে থাকে ঘনিষ্টতা। দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন ।

SR-20

প্রথমে সম্পর্কের টানা পোড়েনে রেজিস্ট্রি বিয়ে। দূর সম্পর্কের বোন হয়ে গেলেন সত্যজিৎ এর ঘরণী বিজয়া রায়। বেশ কিছুদিন টানাপোড়েনের  পর মা সুপ্রভাদেবী  ঘরে তুললেন পুত্রবধূ বিজয়া রায় কে।  কলকাতায় এসে সামাজিক অনুষ্ঠান  করা হয়। সেই দিনের কথা আজও মনে আছে বিজয়া দেবীর । স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলে ফেললেন সেদিনের  বেশ কিছু অজানা কথা । যেমন সদ্য বউ হয়ে এসে শাশুড়ি মা সুপ্রভাদেবীকে জিঞ্জেস করেছিলেন কী বলে ডাকব ? উত্তরে সেদিন সুপ্রভাদেবী বলেছিলেন,”এবার শুধু মা  বলেই ডাকবি ।”

BIJOYA RAY-03 (2)

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বিজয়া রায়ের বৈবাহিক সম্পর্ক সে সময়ের  সমাজ খুব আন্তরিকতার সঙ্গে মেনে নেয়নি । প্রায়ই  নানা কটূক্তি শুনতে হত এই যুগল দম্পতিকে। আড়ালে আরও কত কী বলা হত, কে জানে!  পরবর্তী জীবনে বিজয়া রায় শুধুমাত্র সত্যজিৎ ঘরণী ছিলেন  তা নয়, তিনি সত্যজিৎ  রায়ের কর্মজীবনের সঙ্গেও নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে ।  কলকাতায় এসে বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। বিজয় দেবীর সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ছিল  । তাঁর গানের গলাও ছিল বেশ  মিষ্টি। তাই তাঁর বাবা চারুচন্দ্র দাস জীবিত কালে চেয়েছিলেন মেয়েকে প্যারিস পাঠাতে পশ্চিমী ধ্রুপদী সংগীতের তালিম নিতে । “কিন্তু সে আশা আর পূরণ হয়নি।”তবে গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রথম দিকে বিজয়া দেবী যোগদান করেন সরকারি সংস্থার কেরানি পদে। পরে সেই চাকরি ছেড়ে চলে যান বোম্বের সিনেমা জগতে । কোনরকম সাফল্য  কথা মাথায় না রেখেই তিনি শুরু করেন অভিনয়। ১৯৪৪ সালে শেষ রক্ষা সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি নেপথ্য গায়িকার ভূমিকাও পালন করেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র, এই দুটি বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও । এই আগ্রহ থেকেই সত্যজিৎ ও বিজয়া দেবীর মধ্যে বাড়তে থাকে ঘনিষ্ঠতা । পরবর্তী কালে এই বিজয়া রায়ই নাকি সত্যজিৎ রায়কে বুঝিয়েছিলেন পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের মধুরতা । বিবাহিত জীবনে সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত কাজেই বিজয়া রায় ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ।  ছবির স্ক্রিপ্ট পড়া থেকে শুরু করে , প্রপস ঠিক করা সব ক্ষেত্রেই । এমন কি অভিনেতা – অভিনেত্রী স্থির করার ক্ষেত্রেও বিজয়া রায়ের কোনও না কোণও  ভূমিকা থাকতই । এককথায় বলা যেতে পারে বিজয়া রায় ছাড়া সত্যজিতের জীবন কখনও পূর্ণতা পায়নি। উদাহরণ স্বরূপ অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় ‘পথের পাঁচালী’র কথা সেখানে অর্থাভাবে যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছবির শুটিং , তখন বিজয়া সত্যজিৎ রায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর সমস্ত গহনা। তিনি ও জানতেন, এই গহনায় পুরো ছবির শুটিং সম্ভব নয় । তবুও তাঁর এই অবদান কি ভোলা যায়! শুধু তাই নয়, সত্যজিৎ রায়  যেমন বিজয়া রায়কেই

শোনাতেন তাঁর স্ক্রিপ্ট,  তেমনি পরবর্তী কালে সাহিত্যচর্চা শুরু করার সময়ও লেখা শেষ হলে প্রথমেই সেটি শুনিয়ে নিতেন তাঁকে। তাঁর মতামতকে  খুব  গুরুত্বও দিতেন সত্যজিৎ রায়।

SR-50

আজ তাঁর বয়স  ৯৮ বছর। তাই বয়সের ভারে বেশি কথাও বলতে পারেন না তিনি। স্মৃতিও আগের মতো সঙ্গ দেয় না।  তাই তাঁর মনের কথার বেশিরটাই বলে দিলেন তাঁর পুত্র- বধূ ললিতা রায় । সন্দীপ রায়ের কথায় আরও জানা গেল -‘বাবা যখন ফেলুদা লিখেছেন, মা তখনও তাঁকে খুব ভাবে  সহযোগিতা করেছেন। আসলে মা ডিটেকটিভ গল্প পড়তে খুব ভালো বাসতেন । হয়তো সেই ভালো-লাগা থেকেই ফেলুদা লেখার কথা মাথায় আসে বাবার । শুধু তাই নয়, বাবা গল্পগুলো ছাপার আগে অবশ্যই দেখিয়ে নিতেন মাকে । কোথাও যদি অসংলগ্ন লাগত, মা সঙ্গে সঙ্গে জানাতেন , বাবাও দেরি করতেন না সেগুলি ঠিক করে নিতেন।’ কথা গুলো বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন সন্দীপ বাবুও । এই কথাগুলো আজও তাঁকে ভাবায় । বর্তমানের কথা বিজয়া দেবী খুব একটা মনে রাখতে পারেন না । সকলকে সঠিক ভাবে  চিনতেও পারেন না । শরীরও আর চলে না। বলতে পারেন  শরীরটা বাইরের চালনা শক্তি দিয়ে চালাতে হয়। মনটাও আর তাঁর আয়ত্তে নেই । কিন্ত অতীতের কথা উঠলে সবই বলে দিতে পারেন । শুনে মনে হয়- বুঝি এইমাত্র সেই সময় থেকে ফিরে এসেছেন ।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.