হাতে স্মার্টফোন!‌ ওরা আসলে কিছুই দেখছে না

আপনি বাস বা মেট্রোয় যাচ্ছেন। আপনার সহযাত্রী আপনার দিকে তাকাচ্ছেও না। সে ব্যস্ত তাঁর মোবাইলে। বা আপনি কারও বাড়িতে গেছেন। সেখানেও কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হবে। মনে হবে, কেন এলাম। কারণ, আপনার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে অনেকের কোনও আগ্রহই নেই। তারাও ব্যস্ত মোবাইলে।

এই প্রজন্মের কিশোর থেকে তরুণ, সারাক্ষণ কিছু না কিছু দেখেই চলেছে। কেউ গেম খেলায় ব্যস্ত। কেউ চ্যাট করায় ব্যস্ত। কেউ কানে ইয়ারফোন গুঁজে কিছু একটা শুনে চলেছে। কেউ ভিডিও দেখে আপন মনেই হাসছে। প্রশ্ন জাগতেই পারে, ওই যন্ত্রটির ভেতর কী এমন রয়েছে। সারাক্ষণ ওরা কীই বা দেখছে?‌

আসলে, ওরা কিছুই দেখছে না। আসলে, ওরা কিছুই শুনছে না। ওরা কোনওকিছুই গ্রহণ করছে না। সারাক্ষণ শুধু প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। সবার আগ্রহ এক খাতে বইবে, এমন নয়। কেউ হয়ত সিনেমা ভালবাসে, কেউ হয়ত খেলা ভালবাসে, কেউ ভালবাসে সাহিত্য, কেউ ভালবাসে গল্প করতে। কিন্তু একটু ভালভাবে মিশে দেখুন, ওরা কী ভালবাসে, ওরা নিজেরাও জানে না।

সোশ্যাল সাইটেও নানা প্রজাতির মানুষ দেখা যায়। কেউ আছে, অহরহ নিজেকে প্রাসঙ্গিক করতে এটা–‌ওটা পোস্ট করেই চলে। তারপর কটা লাইক আর কমেন্ট পড়ল, সারাদিন তার হিসেব কষে। কেউ কেউ আছে, নিজে তেমন কিছু পোস্ট করে না, কিন্তু অন্য কে কী পোস্ট করল, সারাদিন সেদিকে নজর। তাই নিয়েই সারাদিন ভেবে চলেছে। এদের বলা যায়, সাইলেন্ট ভিউয়ার। পাঁচ মিনিট ছাড়া ছাড়া ইচ্ছে হচ্ছে, দেখি তো, কে কী ছবি ছাড়ল। তারপর প্রকাশ্যে কমেন্ট হয়ত করছে না। কিন্তু মনে মনে নানা প্রতিক্রিয়া দিয়েই চলেছে। এদের উপস্থিতি অন্যরা তেমন টের পাবে না। কিন্তু এরাও দিনে বড় একটা সময় এই মোবাইল হাতেই কাটায়। আসলে, কে কী করছে, সীমাহীন কৌতূহল আর নজরদারি। দিনভর লোকের ওপর নজরদারি করেই দিন কেটে গেল। দিনের শেষে নিজের বলে কিছু রইল না।

যে সিনেমা ভালবাসে, সে সপ্তাহে কতগুলো পুরো সিনেমা দেখেছে?‌ যে সাহিত্য ভালবাসে, সে পিডিএফে বা অনলাইনে কতগুলো বই পড়েছে?‌ যে অডিও বুক শুনতে ভালবাসে বলে দাবি করে, সে কতগুলো গোটা উপন্যাস শুনেছে?‌ যে গান ভালবাসে, সে কতগুলো গান মন দিয়ে শুনেছে?‌ কতগুলো গান গাইতে পারবে?‌ একটু বিস্তারিত খোঁজ নিলেই বুঝতে পারবেন, সে সবকিছুই হয়ত খাপছাড়া খাপছাড়া দেখেছে বা শুনেছে। যেটা শুরু করেছে, সেটা শেষ না করে মাঝপথেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে।

এটাই হল মূল সমস্যা। ফোকাস। ফোকাস। মোবাইলে মগ্ন বিরাট অংশের তরুণদের মধ্যে সেই ফোকাসটাই নেই। সারাদিনে ওদের স্ক্রিনটাইম হয়ত দশ থেকে বারো ঘণ্টা। মানে, এতটা সময় মোবাইল হাতে কাটায়। যে সময় মোবাইল হাতে নেই, তখনও কিন্তু ভাবনায় সেই মোবাইলই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সময়টা আরও দু–‌তিন ঘণ্টা। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মোবাইল সংযোগ অন্তত বারো থেকে পনেরো ঘণ্টার। তার পরেও দিনের শেষে প্রশ্ন করুন, সারাদিনের প্রাপ্তি কী ?‌ বলার মতো বিশেষ কিছুই থাকবে না। না সে গোটা সিনেমা দেখেছে, না সে নাটক দেখেছে, না সে দীর্ঘ লেখা পড়েছে, না সে গোটা কোনও অডিও বুক শুনেছে।

অথচ, যদি সে একটা উপন্যাসের অডিওবুক পুরো শুনত, তাহলেও বলতে পারত, আমি এই উপন্যাসটা পুরো শুনেছি। যদি সে একটা সিনেমাও পুরো দেখত, তাহলেও বলতে পারত, ওই ছবিটা পুরো দেখেছি। দিনের শেষে সেটাও একটা প্রাপ্তি হত। যে প্রাপ্তির কথা তার পাঁচ বছর পরেও মনে থাকত। কিন্তু আসলে সে কিছুই দেখেনি। তাই পরের দিন কোনওটাই মনে থাকে না। প্রাপ্তির ভাঁড়ার কার্যত শূন্য। হ্যাঁ, তারা কিছুই গ্রহণ করে না। শুধু প্রত্যাখ্যান করে চলে।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.