ময়ূখ নস্কর
কে ডাকছে আমাকে?
ঠুক-ঠুক-ঠুক। দরজায় টোকা পড়ছে খুব আস্তে আস্তে। ঠুক-ঠুক-ঠুক।
নিখিলবাবু নাকি? এত রাতে? নাকি রাত শেষ হয়ে গেল? কটা বাজে এখন? নিখিলবাবুকে বলেছিলাম, সূর্য ওঠার আগেই ডেকে দিতে। ভোরের হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব মুরাডি লেকের পশ্চিমপাড়ে। সেখানে মাটি হঠাৎ উঁচু হয়েছে টিলার মতো। সেখানে বসে তাকিয়ে থাকব পুব দিকে। ঠুক-ঠুক-ঠুক। “নিখিলবাবু একটু দাঁড়ান।”
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে দরজার ছিটকিনির নাগাল পেলাম। চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে। যেন সারা রাতের অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে দুচোখের পাতায়। দরজা খুলতেই হু-উ-স হাওয়ার ঝাপটায়, হাওয়ার ঝাপটায় নাকি আলোর ঝাপটায়, অন্ধকার সরে গেল। খুলে গেল চোখ। বাইরে এত আলো! এ তো ভোরের আলো নয়। ঠুক, ঠুক, ঠুক, টোকা দেওয়ার শব্দটা একনাগাড়ে চলছে। নিখিলবাবু তো নেই ? কেউই নেই। তাহলে কে দিচ্ছিল টোকা ? কে ডাকছিল আমাকে? দিগন্তছোঁয়া জলাশয়ের হাওয়া ? পলাশ বনের পাখি ? নাকি শুক্লপক্ষের অতন্দ্র চাঁদ ?
জ্যোৎস্নায় ডুবে যাচ্ছে বড়ন্তির বন। ‘স্বচ্ছ তিমিরে তারা অগণ্য জ্বলে।’ আর জ্বলে জোনাকি। হাজারে হাজারে নাকি অযুতে অযুতে ? জ্বলে ছায়াময় বনের অলঙ্কার হয়ে। জ্বলে ভাটফুলের ঝোপেঝাড়ে। জলের কিনারায়। হ্রদের জলে তাদের আলোর ছায়া নাচে।
রাত্রি নিঃশ্বাস ফেলছে দ্রুত। এপারে নিঃশ্বাস ফেলছে বন। ওপারে ফেলছে পাহাড়। হ্রদের জল ছুঁয়ে সেই নিঃশ্বাস আমার গায়ে লাগছে। ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। নাকি আমি ঘুমিয়েই আছি ? যা দেখছি, তা স্বপ্ন? জঙ্গলে অবিরত কীসের আওয়াজ? ঠুক ঠুক ঠুক। কে ডাকছে আমায় ?
****
বা-ব-উ। চিৎকার করে ডাকছে ছেলেটা। কী যেন নাম ওর ? রিসর্টে রান্না করে।
রাতে কী খাবেন বাবু ?
রাতে কী খাব, তা এখনই বলব কী করে ? সবে তো ভোর হল। বাড়িতে থাকলে এসময় ঘুম থেকেই উঠি না।
তাড়াতাড়ি বলতে হবে বাবু। মুরগি খেলে হাটে কিনতে যেতে হবে। বলে, পাহাড়ের বাঁকে সোনালি আলোয় মিলিয়ে গেল সেই ছেলে।
মুরাডি হ্রদের চারিদিকে পাহাড়। উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে পাহাড়, পশ্চিমে পাহাড়। জলের গা ঘেঁসে। আর পূবে ? হ্রদের ধার বরাবর লম্বা বাঁধ। তার ওপারে ধানের ক্ষেত। তার ওপারে আলোর পাহাড়। জলের উপরে ঝুঁকে নিজের মুখ দেখছেন সূর্যদেব। দিনের প্রথম আলো এসে পড়েছে বাঁধের উপরে লালমাটিতে। পলাশ বনের গলিপথের ভিতরে। আর পড়েছে ঘুমকাতুরে পাহাড়গুলোর মাথায়। কী নাম ওই পাহাড়গুলোর ? যাদের ছায়া অনন্তকাল ধরে হ্রদের জলে কাঁপে ?
কী নাম ওই লোকটার ? তিনিও কি অনন্তকাল ধরে ভেসে রয়েছেন ওই জলে ? গতকাল সন্ধ্যেতেও দেখেছি, তিনি জলের উপরে ভাসছেন। মাছ ধরছেন ভেলায় চেপে। হ্রদের যে প্রান্তে কলমি ঝোপের ফাঁকে একটু পরিষ্কার, সেখানে তাঁর সাইকেল রাখা। আর খাবারের পুঁটুলি।
চান করবেন নাকি বাবু ? যেন সহজ পাঠের পাতা থেকে উঠে এসে বললেন লাঙল কাঁধে এক মানুষ। সাবধানে নামুন, জলে ভিজে পাথর পেছল হয়ে আছে।
পাথর ভেসে জলে, আর জল ভেজে আলোয়। এই হ্রদ রাত্রে ভেজে রুপোয়, সকাল সাঁঝে সোনায়। শীতকালে এই জলে ভেসে বেড়ায় পরিযায়ী পাখি। সোনালি আলোয় জল যখন উপচে পড়ে, তখন ওরা গলা তুলে ডাকে। তীরের বাবলা গাছের ডালে বুলবুলিরা তাদের ডাকে গলা মেলায়। কে জানে, কাকে ডাকে ওরা ?
বাবু, পকোড়া রেডি। মুড়ি, লঙ্কা , পেঁয়াজ। পাখির ডাকে মিশে গেল ছেলেটার গলা। ওই তো, দূরে পাহাড়ের ঢালে সে দাঁড়িয়ে আছে।
****
ভাঙা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটা। থেকে থেকে হর্ন দিছে। আমার তো আজ কোনও তাড়া নেই। তবু কেন ডাকছে আমাকে ?
কঙ্কালিমাতার মন্দির শুকনো ঘাসে ছেয়ে গিয়েছে। গর্ভগৃহের সামনে শুকনো কাঁটাঝোপ। তার সামনে এক শুকনো বুড়ি। পাহাড়ের পা ছোঁয়া মাঠ পুরা নিদর্শনে ভরা। ভাঙা মন্দির, ভাঙা দালান, ভাঙা খিলান। ভাঙা তোবড়ানো গাল নেড়ে গল্প শোনায় বুড়ি।
আমি যখন বিয়ে হয়ে আসি, তখন মন্দিরের ওই উঁচুতে একটা সবুজ পাথর লাগানো ছিল। এখন আর কিছু নেই বাবা।
যা ছিল, তা আর নেই। যা আছে, তাই বা কদিন থাকবে ?
ওই যে উঁচু ঢিবি, ওখানে নাকি রাজার সোনা-দানা থাকত। ওই যে বাড়িটা, চারটে দেওয়াল চারদিকে হেলে পড়েছে, ওটা নাকি ছিল রানীদের সাজঘর। ওই দূরের রাসমঞ্চ। ওই গাছের তলায় কল্যাণেশ্বরী দেবীর আদি মন্দির। ওই দূরে ….
বড়ন্তি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে পঞ্চকোট রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ। বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বিদের ভুলে যাওয়া রাজ্যপাট।
দোল পূর্ণিমা আসছে। শীতের অবসাদ ঝেড়ে ফেলে তপ্ত হয়ে উঠেছে পুরুলিয়ার বাতাস। পলাশের পাতাহীন ডালে লেগেছে সেই উত্তাপের ছোঁয়া। বড়ন্তি গ্রামে, মুরুডি হ্রদে অথবা এই ধ্বংসাবশেষের চারিদিকে পূর্ণ জৌবনে সাজছে পৃথিবী। ‘ আজ বনে বনে খেলে হোরি’। কে খেলে ? লাল মাটির বুকে কে ছড়ায় পলাশের ফুল ? গরু চরিয়ে ফেরার পথে কারা পায়ে দলে যায় তাদের ?
ক্ষয়ে যাওয়া পঞ্চরত্ন মন্দিরের আড়াল থেকে আবার হর্ন দিচ্ছে গাড়িটা। আসুন দাদা, ফিরতে হবে।
ফিরতে হবে ? কোথায় ফিরব ? শহরে নাকি সেই হ্রদের কিনারায় ? সেখানে এখন জলের উপরে ঘরফেরা গরুর পালের ছায়া পড়েছে। হলদে সেলোফেন পেপারে মুড়ে গিয়েছে চরাচর।
যাবার পথে পুকুরপাড়ের মন্দিরটা দেখে যাস রে বাবা। রানীরা ওখানে পুজো দিত। সামনে ডাকে ড্রাইভার, আর পেছনে ডাকে ছাগল চরানো বুড়ি।
*****
সামনে ডাকে মুরাডি স্টেশন। পিছনে ডাকে বড়ন্তি গ্রাম। গাড়ির চাকায় তার পথে পথে ধুলো ওড়ে। পোশাকে লেগে যায় লাল ছোপ।
এবার পুজোর সময় আসুন। বললেন নিখিলবাবু। আপনাকে জয়চন্ডী পাহাড়ে নিয়ে যাব। সেই যেখানে ‘হীরক রাজার দেশে’র শুটিং হয়েছিল। যেখানে রোদ বাতাসের দাপটে পাথরগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিচিত্র সব আকার নিয়েছে।
আবার আসবেন। আকাশমণি রিসর্টে থাকতে হলে ফোন করবেন ৮০১৭২১৫৯৫৮ নম্বরে। বড়ন্তি ওয়াইল্ড লাইফ অ্যা্ন্ড নেচার স্টাডি অর্গানাইজেশনে থাকতে হলে ই মেল করবেন baranti01@gmail.com এ। গড়পঞ্চকোটে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের রিসর্ট আছে। সেখানেও থাকতে পারেন।
মুরাডি স্টেশনে লোকাল ট্রেন ঢুকছে। যাবে আসানসোল বা আদ্রা স্টেশনে। তীব্র হুইসলে সে আমাকে ডাকে।
****
ঠুক ঠুক ঠুক। কে ডাকছে আমাকে ?
আসুন বাবু বড়ন্তিতে। হ্রদের জলে শরতের মেঘ ভেসে যায়। আসানসোল স্টেশন থেকে একটা গাড়ি বুক করুন। ডিসেরগড় ব্রিজ, সড়বড়ি মোড়, কোটালডি, রামচন্দ্রপুর, তারপর মুরাডি গ্রাম, বড়ন্তি গ্রাম। তারপর নাম না জানা এক পাহাড়ের কোমর ধরে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে পোস্ট কার্ডে দেখা জলাশয়। মুরাডি হ্রদ। তীরে তার তালের সারি। বুকে তার পাহাড়ের ছায়া। ওপারে পলাশের বন। সেই বনের মধ্যে রিসর্ট। সেখানে ঘুমকাতুরে পাহাড়ের মাথায় ডুবে যায় চাঁদ। বনে বনে নাচে জোনাকির ছায়া। সেখানে সারা রাত বনের গভীরে ঠুক ঠুক ঠুক ….
কে ডাকে আমায় ? দিগন্তছোঁয়া হ্রদ ? হ্রদছোঁয়া পাহাড় ? পাহাড়ছোঁয়া বন ? নাকি শুক্লপক্ষের অতন্দ্র চাঁদ ?