ব্যান্ডপার্টির একাল সেকাল

সংহিতা বারুই

 

সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। দিপাবলী শেষে পাড়ায় পাড়ায় চলছে কালী ঠাকুর ভাসানের মিছিল। এমনই এক মিছিলের পুরোভাগে থাকা উদ্যোক্তাদের ঠিক পিছনেই চলেছে ব্যাগপাইপ সম্বলিত আলি হোসেন ব্যান্ড। মধ্যমণি স্বয়ং আলি হোসেন সাহেব। তাঁর মুখের ক্ল্যারিওনেটে যখন বেজে উঠল “মায়ের পায়ের জবা হয়ে…”, সামান্য বেসামাল এক ক্লাবকর্তা  আর থাকতে না পেরে লুটিয়ে পড়লেন আলি সাহেবর পায়ে। আবেগে উথলে ওঠা চোখের জলে, পথের ধুলোর সঙ্গে ভিজে গেল ব্যান্ড সর্দারের নাগরা ।

স্মৃতির পাতা আরও একটু পিছনে ওল্টালে দেখা যাবে , গ্রামের জমিদার বাড়ির বিয়ে, পুজো-আচ্চা সহ যাবতীয় আনন্দ অনুষ্ঠানে কলকাতার ব্যান্ডপার্টি ছাড়া ভাবাই যেত না। ‘কলকেতা থেকে ইংরেজি বাজনা আনতে হবে। সঙ্গে  লন্ঠন ওয়ালা ।’ – গিন্নিমা আর বাড়ির ছোটদের আবদার  হাসিমুখেই মেনে নিতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারবাবু । খেত- পুকুর- বাঁশবনের পাশ দিয়ে, আলপথ ধরে , কখনও নববধূর পালকির আগে , কখনও গাজনের সঙ পিছনে রেখে ব্যান্ড পার্টির  গ্রাম পরিক্রমা সেকালের নিস্তরঙ্গ জীবনের এক অদ্ভুত ছন্দের অবতারণা করত।

band2

বলাই বাহুল্য, জাঁকজমক টেক্কা দেওয়ার এই জমিদারি যুদ্ধে বাজনাদাররাই আখেরে লাভের মুখ দেখতেন। একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে , রংবেরঙের জরির  পোশাক পরা ইংলিশ ব্যান্ডের দল আসলে শুধু সময়কে ধরে রাখা হেরিটেজই নয়, নির্ভেজাল ‘অ্যান্টিক’ ও বটে। কলকাতার চিৎপুর এলাকায় একশো  বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রাশব্যান্ড বা ইংলিশ ব্যান্ডের রাজত্ব , এই সংস্কৃতি শিল্পের যুক্ত অধিকাংশ  মালিক- কর্মীরই  আদি বাসস্থান বিহারে । অনেকেই প্রায়  তিন পুরুষ ধরে ব্যান্ডের স্যাক্সোফনে সুর তুলে চলেছেন। মূলত পুজো-পরব ও নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রায়  সারাবছরই এদের ডাক পড়ে। এক একটি দলে ১৬ জন বা তার বেশি সদস্য ও থাকতে পারে । বরাত অনুযায়ী দলগুলোকে ছোট বড় করে নেওয়া হয়। যেসব মাসে কাজ থাকে না সেই সময় এরা নিজেদের মুলুকে ফিরে গিয়ে চাষ আবাদ এবং অন্যান্য ছোট খাটো কাজকর্ম করে গ্রাসাচ্ছাদন করেন। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ভাদ্র, পৌষ এবং চৈত্রমাস বাদ দিয়ে বছরের বাকি ৯মাস  বাজনার বরাত বেশ ভালোই থাকে। পুরো মরসুমের জন্যে প্রতি ১ জন পিছু পারিশ্রমিক মেলে ৬০-৮০ হাজার টাকা । এর মধ্যে ২৫ শতাংশ অর্থ পায় সংশ্লিষ্ট  দলের কর্তারা । অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্যে বেশি ডাক আসে বর্ধমান, কালনা, কৃষ্ণনগর , পশ্চিম মেদিনীপুর , মালদহ , দুর্গাপুর , মালদহ , এসব জায়গা থেকে । সত্যি  কথা  বলতে কি, বর্তমানের চটুল ‘ধামাকা কালচার ‘ সম্বলিত কলকাতা শহরে ইংলিশ ব্যান্ডের কদর ইদানীং অনেক বেশি । পোশাক, বাজনা ও আনুষঙ্গিক সরজ্ঞামের ব্যবস্থা করা দলের মালিকেরই দায়িত্ব। এছাড়াও কর্মীদের  সুখস্বাচ্ছন্দ্য  ও শরীর স্বাস্থ্যের প্রতিও তারা যথেষ্টই নজর রাখেন। বাজনা গুলির মধ্যে ড্রাম , করতাল , ইনফোনীয়াম, মারাকাস, ঝুমুর, সানাই, তাসা, ব্যাগপাইপ, ব্যারিটোন, স্যাক্সোফোন, ক্ল্যারিওনেট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। যেসব জায়গায় বায়না থাকে , সেখানে ৩-৪ ঘণ্টা বাজাতে হয়। অতিরিক্ত সময় বাজালে, টাকার অঙ্কও সামান্য বাড়াতে হয়। পুরো ‘কন্ট্র্যাক্ট’ – এর মধ্যে বিশ্রামের সময় ধার্য্য থাকে ঘণ্টাখানেক। এই শিল্পে যুক্ত পরিবার গুলির বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও  এই ব্যবসার সম্পর্কে আগ্রহ রয়েছে। কারণ , এখানে অল্প পরিশ্রমেই যেমন রয়েছে ভদ্রস্থ আয়ের হাতছানি, তেমনই সঙ্গীতের    মূচ্ছনায় মানুষকে আনন্দ দেওয়ার তৃপ্তিও কিছু কম পাওয়া নয়।

band4

শুধু অবাঙালি নয়, বাঙালিদের বিয়ে অনুষ্ঠানেও এখন ইংলিশ ব্যান্ডের কদর বাড়ছে। পাশাপাশি বৃহত্তর বাংলায় ক্রমেই বাড়ছে নানা পার্বণের ধুম। তাই, বছরের কয়েকটা বাদ দিয়ে ইংলিশ ব্যান্ডবাদকদের  যথেষ্টই ডাক আসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোনও কারণে বাজানোর অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেলে এরা অগ্রিমের প্রায় পুরো অর্থই ফেরৎ দিয়ে দেয়। যদিও বুকিংয়ের সময় মোট বায়নার অর্ধেক টাকা দিয়ে দিতে হয় এবং বাকি অর্ধেক অনুষ্ঠানে বাজনা শুরু করার আগে।   কারণ, বাস্তব  পরিস্থিতি অনুযায়ী বাজানোর পরে ব্যান্ডের দলগুলো  আর্থিক লেনদেন করতে চায় না।

আমাদের বদলে যাওয়া পছন্দের  তালিকায় অন্য রকম ‘ব্যান্ড’ তার  দুর্বোধ্য  শব্দব্রহ্মে হয়তো হালফিলের মিউজিকে পরিবর্তন ঘটাতে পারে । কিন্তু সাবেক হিন্দিগানের কলি থেকে আজকের বিশ্বায়িত বাংলা ‘বই’ -এর অদ্ভুতুড়ে সুর, চিৎপুরের ইংলিশব্যান্ড সবকালেই সাবলীল।  তাই তো তার সম্পর্কে অনায়াসেই বলা যেতে পারে, ‘তওবা তেরা জলওয়া………।।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.