অন্তরা চৌধুরি
পুরীর স্বর্গদ্বার ভালো লাগে না, এমন মানুষ আছে কি না সন্দেহ। এইরকম আনন্দধাম বিশ্বে বোধহয় আর দুটি নেই। সি বিচের ওপর বসে থাকতে থাকতে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় বোঝাই যায় না। সন্ধ্যেবেলার কী অদ্ভুত মায়াবি পরিবেশ। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস। একের পর এক সমুদ্রের ঢেউ আসছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। অবিরাম। অবিশ্রাম। ক্লান্তিহীন। গোটা স্বর্গদ্বার জুড়েই যেন আনন্দের মেলা বসেছে। এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত লাইট জ্বলছে। কোথাও সাদা কোথাও হলুদ লাইট। সমুদ্রের হাওয়ায় সেগুলো নড়ছে। গোটা স্বর্গদ্বার জুড়েই হরেক রকমের পসরা সাজানো। যে যার মতো কিনছে। দূর থেকে ভেসে আসছে হরেক রকম শাঁখের আওয়াজ। বাঁশীর আওয়াজ। হাওয়াই লাড্ডুর টুংটুং ঘণ্টাধ্বনি। মানুষের বিচিত্র কলতান। চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে কখনও উট, কখনো ঘোড়া। টাকার বিনিময়ে মানুষের একটুখানি আনন্দযাপন। কত উজ্জ্বল মুহুর্ত। সব মুঠফোনে বন্দী হচ্ছে। সবকিছুকে ছাপিয়ে মাঝে সমুদ্রের একটানা বিরামহীন গর্জন। সাঁঝবতির আলোয় সেখানে তখন এক বিচিত্র রূপকথার জন্ম হয়। স্বর্গ কেমন হয়ে জানা নেই। কিন্তু আমার কাছে তখন ওটাই স্বর্গ।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছি। কিন্তু প্রকৃতি বেশীক্ষণ মৌনতা পছন্দ করে না। একের পর এক কতই না বিচিত্র জিনিস তাদের পসরা সাজিয়ে আসে আবার চলে যায়। কোনওটা কিনি। কোনওটা ফিরিয়ে দিই। এমন সময় কানে এল উড়িয়াভাষী বিচিত্র সুমিষ্ট সুরেলা কন্ঠ-
‘মদনোমোহনো, রাবড়ি, রসগোল্লা’।
দেখি একটা লোক বাঁকে করে মিষ্টি বিক্রি করছে। সেই বাঁকের দুদিকে একের পর এক অ্যালুমিনিয়ামের বাটি চাপানো। যারা পুরী গেছেন তাদের কাছে এই দৃশ্য অত্যন্ত পরিচিত। শেষের দুটো মিষ্টি পরিচিত হলেও মদনোমোহোনো তো কখনও খাইনি। সেটা কী জিনিস দেখতেই হচ্ছে। তাই তাকে ডাকলাম-
‘ওহে মদনোমোহোনো এসো। দাও দেখি তোমার মদনোমোহোনো।’
সেই লোকটি তার ভারি নামিয়ে রেখে শালপাতায় দুটি করে মদনমোহন দিল। সঙ্গে একটা কাঠি। মিষ্টিটা দেখতে বেশ অদ্ভুত। পান্তুয়ার শাঁসের মতো গায়ের রং। ডিজাইনটা শিবের কল্কের মতো। অপূর্ব তার টেস্ট। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় যাকে বলে। যেন জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। এমন সুন্দর মিষ্টি আগে কখনও খাইনি। তার ওপর সমুদ্রের ধারে বসে খেলে যে কোনও জিনিসের স্বাদই কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মদনমোহন খাওয়ার পর খেলাম পুরীর বিখ্যাত রাবড়ি। এর আগে যতবারই পুরী গেছি এই লোকগুলোকে মাটির হাঁড়িতে করে বিক্রি করতে দেখেছি। প্রবল ইচ্ছে হয়েছে জানার যে কী আছে ওই ভাঁড়গুলোতে। কিন্তু মা বাবার ভয়ে বলতে পারিনি। বর খাদ্যরসিক হওয়ায় সে ভয় ছিল না। আর সে কারণেই মদনমোহনের এমন স্বর্গীয় স্বাদ অনুভব করার সুযোগ এসে গেল। মদনমোহন নাম হওয়া তার সার্থক।