অন্তরা চৌধুরি
পনেরোই আগস্ট বা ছাব্বিশে জানুয়ারি এলেই গানটি ঠিক বেজে উঠবে। লতা মঙ্গেশকার যেখানেই অনুষ্ঠান করুন, এই গানটি তাঁকে গাইতেই হবে। গানটি শুনে শিশুর মতো কেঁদে ফেলেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।
কোন গান? এই তিনটি ক্লু দেওয়ার পর সঠিক উত্তর বলার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। গানটি নিছক আর গান নেই। প্রায় ছয় দশক পরেও আসমুদ্রহিমাচল আন্দোলিত হয় এই গানটিকে ঘিরে। সব ভাষার প্রাচীর ভেঙে গানটি পৌঁছে গেছে হৃদয়ের গভীর গোপনে।
কিন্তু কীভাবে তৈরি হল এই ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো?’ না, এই গানটি কোনও সিনেমার জন্য লেখা হয়নি। লেখা হয়েছিল ১৯৬২–র ভারত–চীন যুদ্ধে শহিদদের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে। গানটি লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ততদিনে তিনি কবি ও গীতিকার হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাঁর লেখা একের পর এক দেশাত্মবোধক গান ফিরছে মুখে মুখে। বাষট্টির যুদ্ধ গভীর ছাপ ফেলেছিল এই কবির মনে। একদিন তিনি মুম্বইয়ের মাহিম সৈকতে হাঁটছিলেন। হঠাৎ মাথায় এল শুরুর লাইনগুলো। একটা সিগারেটের প্যাকেটেই লিখে ফেললেন শুরুটা।
ঠিক কয়েকদিন পর, প্রযোজক মেহবুব খান জানালেন, শহিদদের সম্মানে দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে একটি বিশাল অনুষ্ঠান হবে। সেখানে প্রদীপকে একটি দেশাত্মবোধক গান লিখতে হবে। প্রদীপ রাজি হয়ে গেলেন। কারণ, গানের অনেকটা তিনি ততদিনে লিখেই ফেলেছেন।
কবি প্রদীপ চাইলেন, সি রামচন্দ্র যেন এই গানের সুর দেন। সেই সঙ্গে চাইলেন, লতা মঙ্গেশকার যেন এই গান গান। ওদিকে, কোনও একটি কারণে রামচন্দ্রর সঙ্গে তখন লতার একটা ভুল বোঝাবুঝি চলছে। তিনি চাইলেন, এই গান আশা ভোসলেকে দিয়ে গাওয়াতে। সেই অনুযায়ী আশা কয়েকদিন রিহার্সালও করলেন। এদিকে, গীতিকারের তখনও মনে হচ্ছে, এই গান লতা ছাড়া অন্য কারও গলায় মানাবে না। অন্য কেউ এই গানের প্রতি সুবিচার করতে পারবেন না। তিনি চলে গেলেন লতার কাছে। সরাসরি আবদার করে বসলেন, এই গান তোমাকেই গাইতে হবে।
ওদিকে লতাও তখন বেশ বিভ্রান্ত। ১) আগেই প্রচার হয়ে গেছে, এই গান গাইবেন বোন আশা। এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে রাজি হওয়া মুশকিল। ২) লতার হাতে তখন অনেক কাজ। শুধু একটি গানের জন্য লম্বা রিহার্সালের সময় বের করাও কঠিন। ৩) এই গান সিনেমার গান নয়। শ্রোতাদের কাছে আদৌ এই গান পৌঁছবে কিনা, তা নিয়েও সংশয়।
এসব কারণে কিছুটা আপত্তিই ছিল। লতা বললেন, এই গান তাঁর একার পক্ষে গাওয়াটা খারাপ দেখাবে। তাই দুই বোন একসঙ্গে গাইলে তিনি রাজি। সেই মতো আশাকে বোঝানোর চেষ্টা চলল। কিন্তু আশা ততদিনে বেঁকে বসেছেন। তিনি কিছুতেই গাইবেন না। আশাকে বোঝাতে আসরে নামলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবু রাজি হলেন না আশা।
লতার আরও একটি আবদার ছিল। এই গানের রিহার্সালের সময় কবি প্রদীপকে থাকতে হবে। গীতিকার এককথায় মেনে নিলেন। তিনি তখনই জানতেন, এই গান অমরত্ব পেতে চলেছে। বারবার লতাকে বলতেন, ‘তুমি দেখে নিও, এই গান মানু্ষ চিরদিন মনে রাখবে।’ কিন্তু রিহার্সালের জন্য হাতে তেমন সময় ছিল না। ঠিক ছিল, গানটি গাওয়া হবে ১৯৬৩–র ২৬ জানুয়ারি, দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। শহিদদের পরিবারকে যেমন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তেমনই হাজির ছিলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু–সহ পুরো মন্ত্রীসভা। বলিউডের তারকারাও হাজির।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ন্যাশনাল স্টেডিয়াম তখন কানায় কানায় পূর্ণ। লতার মর্মস্পর্শী গলায় যেন নতুন করে প্রাণ পেল গানটা। প্রধানমন্ত্রীর চোখ দিয়ে তখন নীরবে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। কান্না চেপে রাখতে পারছেন না শহিদ পরিবারের লোকেরাও। নেহরু বলেছিলেন, এই গান শোনার পর যদি কারও চোখে জল না আসে, তাহলে সে ভারতীয়ই নয়।
কেটে গেল ৫৯ বছর। কালের স্রোতে কতকিছু হারিয়ে গেল। কিন্তু যত দিন গেল, এই গান যেন ততই জীবন্ত হয়ে উঠল। লতা যে অনুষ্ঠানেই যান, এই গানের অনুরোধ আসবেই। এত বছর পরেও কিংবদন্তি শিল্পী বলে ওঠেন, ‘এই গানটা যে আমার জীবনের সিগনেচার টিউন হয়ে উঠবে, সেদিন ভাবতেও পারিনি। আমার সব গান মানুষ ভুলে গেলেও এই গানটা ঠিক মনে রাখবে। কবি প্রদীপের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। তিনি বলতেন, এই গান মানুষ কোনওদিন ভুলবে না। তিনি কত আগে এই ছবিটা দেখতে পেয়েছিলেন।’