রাজাভাতখাওয়ার সেই ছোট্টা ঝোরা,চাঁদের আলোমাখা সেই ডিমা নদী

সন্তু বিশ্বাস

এবারের মত অবশেষে শেষ হয়ে গেল আমার উত্তরবঙ্গে চাকরির পালা। উত্তরের সঙ্গে আমার চারবছরের ঘরকন্না শেষ। পাকাপাকিভাবে উত্তরবঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পদাতিক এক্সপ্রেস যখন নিউ আলিপুরদুয়ার ছাড়ল, তখন বিগত চার বছরের অনেক কথা মনে পড়ে গেল। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলাম। আজ চলে যাচ্ছি। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে। বছরের পর বছর কাটাতেও হয়েছে। সেইসব জেলার নাড়ির স্পন্দন অনুভব করেছি। কত গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি। কোনও পোষ্টিংয়ের শেষে এতটা খারাপ কখনও লাগেনি। এখানকার মানুষগুলোও এখানকার প্রকৃতির মতো উদার ও সরল। উত্তরবঙ্গ আমাকে আরও নিবিঢ়ভাবে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। যখনই সময় পেয়েছি, ছুটে গিয়েছি তিস্তা, তোর্ষা আর জয়ন্তীর কাছে। ওরাও আমার বাউন্ডুলেপনাকে বারবার প্রশ্রয় দিয়েছে। আরও কাছে টেনে নিয়েছে। ওদের রূপে চারবছর ধরে মুগ্ধ হয়ে থেকেছি। সেই মুগ্ধতা সারাজীবনের মাদকতা হয়ে রইল। এই মাদকতা ছেড়ে যাওয়া যে কী বেদনাদায়ক, তা বলে বোঝানো দুষ্কর।

ওরা তো শুধু নদী নয়। ওরা ছিল আমার চার বছরের মননের সঙ্গী। এখানকার জঙ্গল যেমন আমাকে অদ্ভুত বাঙ্ময় নৈঃশব্দের আনন্দ দিয়েছে, তেমনি নদীরা দিয়েছে ক্লান্তিকর পেশাগত জীবনের বাইরে ছন্দের আর উদ্দামতার আনন্দ। শুধু তিস্তা–‌তোর্ষা–‌জয়ন্তীই কেন, আমি বারবার ছুটে গেছি ডায়না, চেল, লিস, নেওড়া, রায়ডাক, সঙ্কোশ, মাল আর কুর্তির কাছে। প্রতিবারেই পেয়েছি উদার আমন্ত্রণ। আজ এদের ছেড়ে যেতে মন মানছে না।

আজ ট্রেনটাকে শাপশাপান্ত করতে ইচ্ছে করছে। ক্রমশঃ, ওদের কাছ থেকে আমাকে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর তো হঠাৎ করে ছুটে যেতে পারব না রাজাভাতখাওয়ায় ওই ঝোরার সামনে, চাঁদের আলোয় ডিমা নদীর ধারের জঙ্গলের অপার্থিব রূপও দেখতে পাব না। অথবা ইচ্ছে করলেই যেতে পারবো না মেচ আর রাভাদের নাচ দেখতে। পাম্পু বস্তির মোমোর দোকান, পানিঝোরার জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট নদী, মেচপাড়া চা বাগানের সবুজ গালিচার ওপারে নীল ভুটান পাহাড়, হাসিমারা এয়ারবেসের কাছে তোর্ষার জঙ্গল, মালবাজার শহরের ছোট্ট অথচ মনোময় পরিবেশ, বীরপাড়া চা বাগানের গা ছমছমে পরিবেশ–‌ আরও কতো কী! সব ইতিহাস হয়ে গেল আজ থেকে।
আমার উত্তরবঙ্গ ছেড়ে যাওয়ার সময় এতটা মন খারাপের আরেকটা কারণ হল আসাম থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া। আসাম আমার দ্বিতীয় ঘর। আমার মনের জায়গা। আবার কবে এদিকে আসব জানি না, তবে দক্ষিণবঙ্গে প্রতিমুহূর্তে যে মানসিকভাবে দগ্ধ হব, তা নিশ্চিত।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.