শুরুর আগেই বর্ণহীন হয়ে গেল বিশ্বকাপ

জগবন্ধু চ্যাটার্জি

ক্রিকেটে আমার প্রিয় দল কোনটি?‌ এখন উত্তরটা নিশ্চিতভাবেই ভারত। কিন্তু আটের দশকে যদি কেউ এই প্রশ্নটা করত, হয়ত একটা অন্যরকম উত্তর দিতাম। কারণ, তখন আমি ভারতের জয় যত না চাইতাম, তার থেকে বেশি চাইতাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়।

পচাত্তর বা উনআশির বিশ্বকাপ দেখার সুযোগ হয়নি। এমনকী তিরাশিতেও না। কিন্তু তারপর থেকেই একটু একটু করে ক্রিকেট বোঝা। ততদিনে জেনেছি, প্রথম দুবার এই দলটিই বিশ্বকাপ জিতেছে। তিরাশিতে এই ক্যারিবিয়ানদের হারিয়েই বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত।

তখন ক্লাইভ লয়েড অবসর নিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই শুরুতে আসবেন ডেসমন্ড হেইনস, গর্ডন গ্রিনিজ। তিনে আসবেন রিচি রিচার্ডসন। তারপর ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে, চুইং গাম চিবোতে চিবোতে ভিভিয়ান রিচার্ডস। আহা, সে কী রাজকীয় ঔদ্ধত্য। এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিলেন। আলতো একটা ছোঁয়া দিলেন। বল যেন ছুটে গেল মাঠের বাইরে। তারপর আবার সেই ব্যাট ঘোরাতে ঘারোতা চুইং গামে মন দেওয়া। যেন কিছুই হয়নি।

ক্রিকেটের সম্রাট বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে তিনি ভিভ রিচার্ডস। তাঁর থেকে বেশি রান বা সেঞ্চুরি অনেকেই করেছেন। তাঁর থেকেও কম বলে সেঞ্চুরিও অনেকে করেছেন। কিন্তু তাঁদের কাউকেই রিচার্ডসের আশেপাশে বসানো যায় না। ভিভ মানেই কৈশোরের সেই মুগ্ধতা। ভিভ মানেই একটা অলস আভিজাত্য। ভিভ মানেই একটা রাজকীয়তা।

কিন্তু সাতাশিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেমিফাইনালেই পৌঁছতে পারল না। তারপর থেকেই যেন গ্রাফটা পড়তে লাগল। কখনও অ্যামব্রোজ এলেন, কখনও কার্ল হুপার এলেন, তারও পরে ব্রায়ান লারা এলেন। তারও পরের দিকে হোল্ডার, ক্রিস গেল, সামি, ব্রাভো। কিন্তু দলগত সেই সংহতিটা যেন হারিয়ে গেল। টি ২০ বিশ্বকাপে দু’‌বার চ্যাম্পিয়ন হল ঠিকই, কিন্তু অতীতের সেই কৌলিন্য ততদিনে হারিয়ে গেছে। গত প্রায় তিন দশক ধরে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ভাবাও হয়নি। তলিয়ে যেতে যেতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সোনালি সেই অতীত। তবু কী করে ভুলব সেই কৈশোরের অনুরাগ!‌ কী করে ভুলব, রিচার্ডসের ছবি কেটে সেই দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া!‌

সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার বিশ্বকাপে খেলবে না!‌ এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। গতবারও তাদের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলেই উঠে আসতে হয়েছিল। এমনকী দশ দলের মধ্যে ছিল ন’‌নম্বরে। তবু তো তারা ছিল। তবু তো মনে হচ্ছিল, লয়েড, রিচার্ডস, লারাদের উত্তরাধিকারীরা আছেন। ক্রিস গেল একটা ছক্কা মারলেই কেমন একটা ভাল লাগা তৈরি হত। কৈশোরের সেই দিনগুলো যেন একটু হলেও উকি দিয়ে যেত। এবার কেমন যেন একটা শূন্যতা নেমে আসবে। এই প্রজন্ম হয়ত বুঝবেও না, ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানে আসলে কী। কিন্তু আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা একসময় রিচার্ডস–‌মার্শালদের ভালবেসেছিলেন। তাঁদের কাছে এবারের বিশ্বকাপ যেন অনেকটাই বর্ণহীন। ‌

‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.