স্মৃতির ব্রিগেড, সহজ পাঠের ব্রিগেড

ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি গরম জামা প্যান্ট পরিয়ে দাও। আমার ধুতি পাঞ্জাবি টা কোথায়? তাড়াতাড়ি দাও। নাহলে ওদিকে আবার খড়গপুর লোক্যালটা ধরতে পারব না। সকাল সকাল হু হু করে উত্তুরে হাওয়া বইছে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বাসে করে পাঁশকুড়া, তারপর ট্রেনে করে হাওড়া। মা বারবার বলে দিচ্ছেন হাওড়ার স্টেশনে বাবার হাত শক্ত করে ধরে রাখবি। প্রচুর লোক হবে। নাহলে হারিয়ে যাবি। হারিয়ে গেলে হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির তলায় দাঁড়িয়ে থাকবি। বাবা ঠিক খুঁজে নেবে। গিরিবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র অরিন। বাবা হাইস্কুল এর শিক্ষক। আবার জেলা পরিষদের সদস্য। বাবার হাত ধরে আজ তার গন্তব্যস্থল কলকাতা। সে কিশলয় বইতে পড়েছে শোভা থাকে কলকাতায়। সেখানে গোলদিঘি আছে। দীঘিটা গোল নয়। ওটা ওর নাম তো। সে আজ দোতলা বাস দেখবে। খুব আনন্দ তার। অরিন তার বাবাকে প্রশ্ন করেছিল বাবা আজ আমরা কলকাতা যাচ্ছি কেন? বাবা বলল ওখানে একটা খুব বড় মাঠ আছে। ওখানে প্রচুর মানুষ আসবেন। অরিনের প্রশ্ন আমাদের ফুটবল মাঠের থেকেও বড়? বাবা শুনে বললেন আরে আমাদের গ্রামের মাঠের থেকেও অনেক গুণ বড়। আসলে অরিন দুই বছর আগে ১৯৮৭ সালে ওদের গাঁয়ের মাঠে প্রচুর মানুষ কে আসতে দেখেছিল। অরিন বাবাকে জিগ্যেস করল কলকাতার বড় মাঠে কি হবে? বাবা অরিনকে বলেছিল ওখানে মৃদুলের বাবা মৃগেনবাবু বক্তব্য রাখবেন। অরিন শুনেই বলল ওও মৃদুলের বাবা মৃগেনবাবু। আমি পড়েছি কিশলয় বইতে। খুব ভাল লোক মূদুলের বাবা। শ্রমিক কৃষক সবাই কে ভালবাসেন। অনেক দেশ ঘুরেছেন। পাঁশকুড়া থেকে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। অরিন খুব আনন্দ পাচ্ছে। সে কলকাতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটা বড় নদী আসতেই তার প্রশ্ন বাবা এটা কি বেত্রবতী নদী? বাবা বলল না এটা রূপনারায়ণ যেখানে আমাদের বাড়ির পাশের কাঁসাই নদী এসে মিশেছে। ওই যে দূরে অনেক নৌকা।‌ ওখানে কি প্রভাত আর আক্রম মাছ ধরছে? অরিনের বাবা মুচকি হাসল। ট্রেনে প্রচুর লোক। কত লোক ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। সবার ব্যাগে মুড়ি শশা পেঁয়াজ। কেউ কেউ পাঁশকুড়া মেছেদার চপ কিনছে। অরিন খুব আনন্দ পাচ্ছে। তারপর ট্রেন অনেক গুলো স্টেশন পার হতেই দেখতে পেল কারখানা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অরিন তার বাবাকে জিগ্যেস করল ওটা কি? বাবা বললো চটকল। অরিন সাথে সাথে বলে ওখানে পরেশ কাজ করে? আমি কিশলয়ে পড়েছি পরেশ কাজে যায়। সে চটকলে কাজ করে। বাবা আবার মুচকি হাসল। অরিন পৌঁছে গেল হাওড়ায়। মায়ের কথামত বাবার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। সে অপার আনন্দ নিয়ে দেখল হাওড়ার ব্রিজ, গঙ্গা নদী, লঞ্চ, ইডেন গার্ডেন, আকাশবাণী ভবন, দোতলা বাস। সে যখন সেই মাঠটায় এল সে দেখতে পেল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। আর লক্ষ লক্ষ মানুষ। সবার হাতে লাল পতাকা। যেন লাল সমুদ্র। যেখানে শুধু লাল লহরী। সে এতক্ষণে বুঝল সে মিটিং এ এসেছে। অরিন বাবাকে জিজ্ঞেস করল বাবা এখানে কারা এসেছে? বাবা একটু থেমে বললেন এখানে তোর কিশলয় বইয়ের ভূষণ এসেছে যে ময়ূর বনের হাটে ধূপকাঠি বেচে। পরেশ এসেছে যে ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করে। রেবা এসেছে যাদের চালাঘর ঝড়ে উড়ে গেছে। বাদল নারান হাসান সবাই এসেছে। ওই বাদল যে গান গায়, ওই হাসান যে সানাই বাজায়। বাবা বলল হ্যাঁ। বাবা অর্জুন সর্দার আসবে না যে ধর্মপুর গাঁয়ে ছুটে গিয়ে খবর দিয়েছিল সুবর্ণরেখা নদীর বাঁধে ফাটল ধরেছে। বাবা কিশলয়ের রঞ্জন মঞ্জুলাদিও তো আসবে। যারা পঞ্চায়েতের মাঠে পঁচিশে বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিন পালন করে। অরিনের বাবা বলল সবাই আসবে। অরিনরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্রিগেড যায় কারণ….
আমরা লড়েছি কাকদ্বীপে
লড়েছি তেলেঙ্গানায়।
আমাদেরই নাম লেখা আছে
ব্রিটিশের জেলখানায়।।

✍️ ড. অরিন্দম অধিকারী।

Share

1 comment

Prabir Samanta says:

লেখকের লেখা পড়ি আর মুগ্ধ হয়ে যাই।
আর সবুজের জন্য অনেক ভালোবাসা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.