কুণাল দাশগুপ্ত
এমনকী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে ঠোঁট মেলাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি কিশোরকুমার। এ বড় অবাক করা ঘটনা। ছ’য়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তি পায় বাংলা ছবি ‘দুষ্টু প্রজাপতি।’ ছবিতে কিশোরকুমারের একাধিক গান থাকলেও ‘সুখ নামে শুক পাখীটি’ গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেই। দুই বর্মণে সমৃদ্ধ হলেও কিশোর কন্ঠে হেমন্তের গান খেলা করেছে দীর্ঘ সময় ধরে।
বাংলা ছবিতে হেমন্ত–কিশোর যুগলবন্দীর শুরু ১৯৫৮ সালে। ‘লুকোচুরি’ দিয়ে। বাংলায় কিশোর কুমারের ছবি বললেই কোন ছবিটা সবার আগে ভেসে ওঠে! এই লুকোচুরি। ছবিতে নায়ক কিশোর কুমার। পরিচালক কিশোর কুমার। প্রযোজকও কিশোর কুমার। অর্থাৎ টাকাও তিনিই ঢেলেছিলেন। সেই ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন হেমন্তকেই। অর্থাৎ, সেই ছবিতে গাওয়া কিশোরের সব গানই হেমন্তর সুরে। বাঙালির একটা সচেতন স্নায়ু যতদিন টিকে থাকবে, প্রাণবন্ত থাকবে, ‘এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়।’ কী আশ্চর্য! একটা দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ মনে করেছে, এটি রবি ঠাকুরের সৃষ্টি। অনেকেই এই ভ্রান্তির শিকার। এমনকী এটা নিয়ে রীতিমতো তর্কও হয়েছে। এ কেমন সম্মোহন মনোবিজ্ঞান যেখানে থমকে যায়। এ কেমনই বা মায়াজাল যেখানে কল্পিত ম্যান্ড্রেক সামান্য শিক্ষানবীশ হয়ে যায়। একই ছবিতে ‘এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়’, সেই ছবিতেই ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’। সুরের বৈচিত্র্য বোঝাতে এর থেকে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে!
আরও একটা কারণে মাইলস্টোন হয়ে থাকতে পারে এই ছবিটি। বাংলা ছবিতে কিশোরকুমারকে প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে দেখা যায় ওই ‘লুকোচুরি’ ছবিতেই। ‘মায়াবন বিহারীণি হরিণী’। রুমাদেবীর সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে। সত্যজিৎ রায় সম্ভবত উৎসাহিত হয়েছিলেন লুকোচুরির থেকেই। বাংলা ছবিতে কিশোরের রবীন্দ্র সঙ্গীত বললেই অনেকে চারুলতার ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ ভেবে বসেন। ঘটনা হল, সত্যজিৎ রায়ের অনেক আগেই এই কাণ্ডটি করে দেখিয়েছিলেন হেমন্ত মুখার্জি। ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ ছবিতেও শীর্ষ সঙ্গীতটি করেন কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যেই। ‘মধ্যরাতের তারা’ তে অতিথি শিল্পী কিশোরকুমারের গাওয়া মজাদার গান ‘জন জন জন জন জন্মদিন’ -এর সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই। সাতের দশকের গোড়ার দিকে নিজের ছবি ‘অনিন্দিতা’তে কিশোর কুমারের গাওয়া ‘ওগো নিরুপমা’ সিনেমা হল থেকে সটান বাঙালির বৈঠকখানায় চলে এল। কমেডি গান করিয়ে ছিলেন ‘প্রক্সি’ ছবিতেও। ‘কী করে বোঝাই তোদের।’ সে গান এখনও সজীব।
মুখোপাধ্যায় ঝেড়ে ফেলে হেমন্ত যখন কুমার হলেন তখন, ‘কুমার হোল স্কোয়ার’ হিন্দি গানে রঙ ঢেলেছেন। ‘গার্লফ্রেন্ড’-এর ‘আজ রোনা পড়া’ বা ‘কস্তিকা খামোশ’ শুধু নয়, ‘খামোশি’ ছবিতে ‘ও সাম কুছ অজীব থী’ বহু মানুষের বহু যন্ত্রণাভরা সন্ধের সঙ্গী হয়ে এসেছে। একই ছবিতে হেমন্ত গেয়েছেন অসাধারণ একটি গান, ‘তুম পুকারলো’। চাইলে এই গানটাও (ও সাম কুছ আজীব থী) গাইতেই পারতেন। কিন্তু সেরা গানটা তুলে রেখেছিলেন কিশোরের জন্য। এখানেই সুরকারের সংযম। সেরা গানটা নিজে না গেয়ে অন্যকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য বড় মাপের কলিজা লাগে।
বড় মধুর সম্পর্ক ছিল দুই কুমারের মধ্যে। কিশোরকুমার অভিনিত ‘দো দুনি চার’ ছবির ‘হাওয়াওপে লিখদো’র হামিং শুনলে বোঝা যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কতটা প্রভাবিত করছিলেন কিশোরকুমারকে। হিন্দিতে কিশোরের লিপে হেমন্তর গান? তাও আছে। কিশোর পরিচালিত দূর গগন কি ছাও মে। সেখানে হেমন্ত গাইছেন, ‘রাহি তু রুখ মত যা না।’
শোনা যায়, কিশোর কুমারকে কলকাতায় প্রথমবার মঞ্চে আনার নেপথ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বড় অবদান ছিল। কিশোর এত এত দর্শকের সামনে গান গাইতে রাজি হচ্ছিলেন না। হেমন্তই তাঁকে ভরসা দেন, ‘তুমি চলো। কোনও চিন্তা নেই। আমি তোমার পেছনেই থাকব। কোথাও কোনও সমস্যা হলে আমি সামলে দেব।’ সামলাতে অবশ্য হয়নি। রবীন্দ্র সরোবরে টানা দেড় ঘণ্টা মাতিয়ে রেখেছিলেন কিশোর কুমার। মঞ্চে গাওয়ার এমন এক আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেলেন, যা দিয়ে মঞ্চ মাতিয়ে গেছেন সারা জীবন।
আরও একটি বাংলা অ্যালবামের কথা না বললেই নয়। কিশোর কুমারের ইচ্ছে হয়েছে, দীর্ঘদিন পর তিনি পুজোর গান গাইবেন। এবং হেমন্তর সুরেই গাইবেন। ক্যাসেট কোম্পানির কর্তারা চাইলেন, হালকা সুরের কোনও গান। হেমন্ত রাজি হলেন না। বললেন, ‘এটা নন ফিল্মি গান। গানের মধ্যেই ছবিটা দেখাতে হবে। এখানে হালকা গান চলবে না। তাছাড়া, সিরিয়াস গান কিশোর দারুণ গায়। আমি বানালে সিরিয়াস গানই বানাব।’ তাই হল, তিনটে সিরিয়াস গান, একটা একটু হালকা স্বাদের। গানগুলো হল আমার পূজার ফুল, চোখের জলের হয় না কোনও রঙ, সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে, কেন রে তুই চড়লি ওরে। পরে মেগাফোন কোম্পানির কর্তা এসে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘কেন রে তুই চড়লি ওরে’টা একটু দলছুট হয়ে গেল। হেমন্ত বলেছিলেন, আমি তো ওটা রাখতে চাইনি। তোমরাই তো জোরাজুরি করলে।
‘আমার পূজার ফুল’ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠল, এখনও পুজো প্যান্ডেলে ওই গানটা বাজে। কিশোরের নিজেরও খুব প্রিয় ছিল এই গানটা। আশি সালের পর থেকে প্রায় সব অনুষ্ঠানেই তাঁর শ্রদ্ধেয় ‘হেমন্তদা’র সুরারোপিত ‘আমার পূজার ফুল’ দিয়ে শুরু করতেন।
মুম্বাই-এর ‘গৌরীকুঞ্জ’-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর একদিন বর্ষামঙ্গল হয়ে ঝড়ে পড়েছিল, কূল ছাপানো সুরনদী আজও স্নিগ্ধ করে সুর পিয়াসী অসংখ্য মানুষকে। কিশোরের বসন্ত জুড়ে ছিলেন হেমন্ত।