অনির্বাণ ঠাকুর
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায় ১৯৫৫ নাগাদ। শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ ১৯৯১ সালে। অর্থাৎ, ছবির জীবন মোটামুটি ৩৬ বছরের। এই সময়ে বাংলা গানের জগতে কারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন? কয়েকটা নাম বলা যাক, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে। আর মেয়েদের মধ্যে গীতা দত্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়। আর মুম্বইয়ের শিল্পী ধরলে লতা মঙ্গেশকার বা আশা ভোঁসলে। আচ্ছা, এঁরা কেউ কি সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গান গেয়েছেন? বা, প্রশ্নটা একটু উল্টেও করা যায়, এঁদের কাউকে কি সত্যজিৎ রায় নেপথ্য শিল্পী হিসেবে ব্যবহার করেছেন?
আচ্ছা, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবির সঙ্গীত পরিচালক কে? একটু ভাবুন। ঠিক ধরেছেন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তাহলেই ভেবে দেখুন, তখন সত্যজিৎ রায় সেই অর্থে কেউ নন। একটি ছবিও করেননি। তখন তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বেছে নিলেন রবিশঙ্করকে। এবার আসুন জলসাঘর ছবির কথায়। সেখানেও সঙ্গীত পরিচালক কিংবদন্তি বাহাদুর খাঁ। কিন্তু আর কোনও ছবিতে কি তেমনভাবে সঙ্গীত পরিচালক বা সুরকারের দরকার হয়েছে? সলিল চৌধুরি, সুধীন দাশগুপ্ত, এস ডি বর্মণ বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের কখনও সুর দেওয়ার জন্য ডাকলেন না কেন? তখন গান লিখতেন কারা? গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, মুকুল দত্ত, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব রায়ের মতো গীতিকাররা। আচ্ছা, এঁদেরও কাউকে সত্যজিতের ছবিতে গান লিখতে দেখা গেল না কেন?
সত্যজিতের ছবির গান বললেই সবার আগে মনে পড়বে গুপী গাইন বাঘা বাইন আর হীরক রাজার দেশের কথা। সেখানে বেশ কয়েকটি গান আছে। প্রায় সবই গেয়েছেন অনুপ ঘোষাল। কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় গেয়েছেন লোকশিল্পী অমর পাল। খালি গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত রয়েছে চারুলতা, ঘরে বাইরেতে। সেখানে গেয়েছেন কিশোর কুমার। অর্থাৎ, কিশোর ছাড়া কোনও তারকা শিল্পীকে তাঁর দরকার হয়নি। তাও অন্য কোনও মৌলিক গানে নয়, নিছকই রবি ঠাকুরের গানে।
যিনি প্রথম ছবিতে পণ্ডিত রবিশঙ্করকে দিয়ে সুর করালেন, তিনি চাইলে পরের দিকে যাকে খুশি, তাঁকে দিয়েই সুর করাতে পারতেন। সত্যজিতের ছবিতে সুর করতে পারলে বা গান গাইতে পারলে শিল্পীরাই ধন্য হয়ে যেতেন। ছবির স্টার ইমেজ আরও খানিকটা বেড়ে যেত। কিন্তু সত্যজিৎ সেই হাতছানিতে সাড়া দিলেন না কেন? একটাই কারণ, ফোকাস। ছবির বিষয়েই ফোকাস করতে চেয়েছেন। ছবিকে ছাপিয়ে গান নিয়ে চর্চা হোক, বা গান ছবির বিষয়কে ছাপিয়ে যাক, এমনটা চাননি। তাই অধিকাংশ ছবিতেই গানকে অনুষঙ্গ করেননি। ছবি হিট করানোর জন্য বা একটা আইটেম বাড়ানোর জন্য গানের শরণাপন্ন হতে হয়নি। পরের দিকের সব ছবিতে তিনি নিজেই সুরকার। সব নেপথ্য সঙ্গীতই তাঁর নিজের।
ছবি থেকে বেরিয়ে এসে এই শিক্ষা যদি জীবনে প্রয়োগ করেন! আমরা একটা কাজ করতে যাই। কিন্তু নানা চোরাগলিতে হারিয়ে যাই। বলতে চাই একটা কথা। কিন্তু শেষমেশ দাঁড়িয়ে যায় অন্য কথা। কখনও কাহিনি হারিয়ে যায় উপকাহিনির ভীড়ে। কখনও নজর টেনে নেয় গান। ছবির বদলে গানের চর্চাই প্রধান হয়ে ওঠে। লেখার বদলে বিন্যাসই যেন বড় হয়ে ওঠে। সত্যজিৎ রায় নিজে একজন দুরন্ত ইলাস্ট্রেশন শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও বুঝতেন, কনটেন্টই আসল। যেখানে কনটেন্টে জোর দিতে হবে, সেখানে অন্যান্য অনুষঙ্গ কমিয়ে আনতে হবে। ছবির ক্ষেত্রে সেটাই প্রয়োগ করেছেন। দর্শককে বিষয়ের দিকে, ভাবনার গভীরতার দিকেই ঠেলে দিয়েছেন। বিনোদনের নামে অযথা গানকে বা নাচকে আমদানি করতে হয়নি।