কুণাল দাশগুপ্ত
গ্রেট ইস্টার্নের সেদিনের সান্ধ্য আড্ডায় ছিলেন তসলিমা নাসরিন, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ পার্থ বসু এবং এই লেখক। কথা হচ্ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিষয়ে। দেবব্রত বিশ্বাস থেকে শান্তিদেব ঘোষ, উঠে আসছিল বহু নাম। বয়সটা তখন অনেকটাই কম। সাহসের একটা আকালই ছিল মনজমিতে। তবু একটা আলতো স্বর বেরিয়ে এসেছিল মন এবং মুখ থেকে। কিশোর কুমার। রবি ঠাকুর গুলে খাওয়া শ্রীমতী নাসরিনের মুম্বইয়া কিশোর কুমার নামটায় যে ভক্তিরসের বিন্দুমাত্র উৎপত্তি হয়নি, সেটা মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমিও আমতা আমতা স্বরে বলে ফেলেছিলাম, তাহলে চারুলতা, আমি চিনি গো চিনি, সত্যজিৎ রায়...। খুব গম্ভীর স্বরে পার্থবাবু বলেছিলেন, ‘সঘন গহন রাত্রি’ গানটা রাত্রে বাড়ি গিয়ে একবার শোনো। যদি বোধ থাকে, তাহলে বুঝবে, এমন কিছু স্বর যা কিনা স্বরবিতানে আবদ্ধ ছিল, কিশোর কুমারের সৌজন্যে তার মধ্যে প্রাণের প্রবেশ ঘটেছিল। ততক্ষণে আমার লিলিপুট সাহস সামান্য হলেও উচ্চতা পেয়েছে। বলেই ফেললাম, আমার অন্ধ প্রদীপরের সঞ্চারীটা...। কথা শেষ হওয়ার পরই পার্থবাবু বলে ফেলেছিলেন, ঠিক বলেছো। এতটাই প্রসন্ন হয়েছিলেন যে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে নিজের পাতায় আমার একটা লেখাও ছেপে দিয়েছিলেন। সেদিন বুঝেছিলাম, রবীন্দ্র সঙ্গীতটা কিশোর কুমারও গাইতে জানেন। হীনমন্যতায় না ভুগে এটা জোর দিয়েই বলা যায়। রবি ঠাকুরের গান বাড়ির ড্রয়িংরুম থেকে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে নিয়ে গিয়েছিলেন কিশোর কুমার। কবিগুরুর গান সর্বত্রগামী হয়েছিল আরও অনেকের মতো কিশোর কুমারের সৌজন্যে।
কিশোর কুমারের রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুটো ভাগ করা যেতে পারে। একদিকে, তাঁর দুটো বেসিক ডিস্ক। আর অন্যদিকে, চারুলতা, লুকোচুরি, একটুকু ছোঁয়া লাগে, ঘরে বাইরে ছবিতে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। ফিল্মে ব্যবহৃত গানগুলো নিয়ে অবশেশনে ভোগা মানুষগুলো ছাড়া কেউ প্রশ্ন তোলেন না। চারুলতায় যখন আমি চিনি গো চিনি গাইছেন, মনে হচ্ছিল কিশোর কুমার তো নন, যেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই গাইছেন। ছাপিয়ে গিয়েছে রাজেশ–কিশোর জুটিকেও। লুকোচুরি ছবিতে রুমা দেবীর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘মায়াবন বিহারিনী হরিনী’ প্রেমের হার্টবিট রচনা করেছে উচ্ছন্নে যাওয়া উস্কো খুস্কো মননেও। আবার যদি ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ গানের দিকে তাকানো যায়, রৌপ্যপদকটি অবশ্যই তৃতীয় গাঙ্গুলির জন্যই রয়েছে। সোনাটা কিন্তু কুন্দনলাল সায়গলই পাবেন। আবার ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পুষ্টিসাধন করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
অন্যদিকে, রয়েছে সেই বেসিক ডিস্কের গান। সময়টা আটের দশকের প্রথমার্ধ। দক্ষিণ ভারতে নির্মিত হিন্দি ছবিগুলির দমাদম সংস্কৃতির তাণ্ডবে মানুষ দিশেহারা। ঠিক তেমনই একটা সময়ে বাজারে এল কিশোর কুমারের রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রথম অ্যালবাম। ওই ৩৩ আরপিএম–ই সাড়ে বত্রিশভাজা সংস্কৃতির ক্ষতে মলম হিসেবে কাজ করল। পুজো মণ্ডপে দুমদাম গানের বদলে এল একটুকু ছোঁয়া লাগে, আমি তোমায় যত, এদিন আজি কোন ঘরে গো..। সেই কবে কুন্দনলাল সায়গাল গেয়েছিলেন। তিনি যেন আবার ফিরে এলেন কিশোর কুমারের ছদ্মবেশে। বৈঠকখানার শোভাবর্ধনকারী রবীন্দ্র সঙ্গীত সর্বত্রগামী হল। বিশ্বভারতীয় সমালোচনা ধোপে টিকল না। মানুষের শংসাপত্রে কিশোর কুমারের রবীন্দ্র সঙ্গীত সুপার ডুপার হিট।
kishore 11
আটের দশকের মাঝামাঝি আবার মাত করলেন কিশোর কুমার। আবার বাজারে এল তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম। দিনের শেষে ঘুমের দেশে, পুরানো সেই দিনের কথা, আলোকের এই ঝর্নাধারায়.. এসব গান দিয়ে সাজানো অ্যালবামকে সমস্ত সাংস্কৃতিক সংকোচকে ঝেড়ে ফেলে গ্রহণ করল দমাদম গান শোনা বাঙালি। হয়ত বা অ্যালবামের গানগুলি একটু নিচু স্কেলেই গাওয়া। কিন্তু তাতে ভাব ও আবেগের কোনও খামতি ছিল না। ছিল না বলেই মানুষের মনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে পেরেছিল সেই গান। সেদিনের সেই ব্যাটন আজ নতুন শিল্পীরা বয়ে নিয়ে চলেছে। যুগান্তরে গতিময় থাকবে সেই ধারা। রবি ঠাকুরের গান অমরত্ব পাবে ‘অরাবীন্দ্রিক’দের মনে। ভাগ্যিস কিশোর কুমার সেদিন ‘রবি স্মরণ’ করেছিলেন। নইলে, আজকের হালফিলি বাংলার কিম্ভুত রবি বিরোধীদের কাজটা অনেকাংশে সহজ হয়ে যেত।