ধীমান সাহা
রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে তিনি তখন বিদায় নিয়েছেন। হঠাৎই উঠে এল বিতর্কটা। প্রণব মুখার্জি কেন আর এস এসের সভায় যাচ্ছেন। যেন প্রণববাবু কী করবেন না করবেন, তা বাকিরা ঠিক করে দেবেন। সবাই বোঝাতে শুরু করলেন আর এস এস কতটা ভয়ঙ্কর, আর এস এস কতটা খারাপ। যেন তাঁরা একাই জানেন, প্রণব মুখার্জি জানেন না।
অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হয়েছিল। কিছু লোকের কাজই হল, জেনে হোক না জেনে হোক, বিতর্ক ভাসিয়ে দাও। কিন্তু খারাপ লাগে, যখন দেখি বুদ্ধিমান লোকেরাও এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন। আর এস এস যে উদ্দেশ্যেই প্রণব মুখার্জিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকুক, প্রণববাবুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করার মধ্যে কোনও অন্যায় ছিল না। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তিনি উচিত কাজই করেছিলেন। তিনি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।
স্বাধীনোত্তর ভারতের রাজনীতিতে সবথেকে বিচক্ষণ মানুষটির নাম প্রণব মুখার্জি। তিনি জানতেন, কোথায় কী বলতে হয়, কোথায় কী বলতে নেই। সুতরাং, এই ব্যাপারে তাঁকে কতই না জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা জ্ঞান দিচ্ছিলেন, তাঁরা বোধ হয় প্রণববাবুর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। তাঁরা প্রণববাবুর প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল, সে ব্যাপারেও ঘোর সন্দেহ আছে।
কতরকম অঙ্ক ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ১) আর এস এস মোদির বদলে তাঁকে তুলে ধরতে পারে। ২) অন্য শরিকদের কাছে টানার ক্ষেত্রে তাঁকে ব্যবহার করা হতে পারে। ৩) তাঁর ছেলে বা মেয়েকে মালদা থেকে দাঁড় করানো হতে পারে। ৪) তাঁকে সামনে রেখে কংগ্রেসকে আরও দুর্বল করার চেষ্টা হতে পারে।
অথচ, নাগপুরের সভায় তাঁর বক্তৃতা আবার শুনে দেখুন। সেখানে তিনি কিন্তু যথার্থ রাষ্ট্রনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। একবারও মনে হয়েছে, তিনি আর এস এসের রাজনীতিকে সমর্থন করেন। সনাতন ভারতের ঐতিহ্যের কথা, পরমত সহিষ্ণুতার কথা, ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থের কথাই উঠে এসেছে। খোদ আর এস এসের সদর দপ্তরে গিয়ে এমন স্পষ্টভাবে নিজের কথা বলতে হিম্মৎ লাগে। প্রণববাবু সৌজন্যের মোড়কেই ভিন্ন সুর তুলে ধরতে পেরেছিলেন। এখানেই তিনি আর দশজনের থেকে আলাদা।
এসব আজগুবি ব্যাখ্যা যাঁরা দিয়েছিলেন, আজ তাঁরা কি আয়নায় মুখ দেখবেন! পাড়ার চায়ের দোকানে যাঁরা দিনরাত নানা ভাষণ দিয়ে যান, তাঁরাও এই বোকা বোকা ব্যাখ্যা দিতে সাহস করবেন না। তাঁদের রাজনৈতিক জ্ঞানগম্যিও এই বিশেষজ্ঞদের চেয়ে ঢের ভাল। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি ভবনকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তার ওপর বয়সও হয়েছিল। তিনি যে আর কোনও দিনই সক্রিয় রাজনীতি করবেন না, এটুকুও সেদিন বোঝেননি সবজান্তা বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু কংগ্রেসের মুখপাত্ররা যেভাবে তাঁকে আক্রমণ করে গেলেন, তাঁরা এই বোধবুদ্ধি নিয়ে কীভাবে মুখপাত্র হয়েছিলেন, সেটা ভেবে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। বিষয়টাকে উপেক্ষা করা যেত। বলা যেত, প্রণববাবু বিচক্ষণ মানুষ, তাঁর ওপর আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু সৌজন্য দেখাতে পারেনি কংগ্রেস। এই অর্বাচীনরা জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় ঘুরে বেড়ায় কী করে?
কার সম্পর্কে বলছি, কাকে জ্ঞান দিচ্ছি! এই বোধটাও সেদিন অনেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন।