(ভোটের ময়দানে আবার স্বমহিমায় মদন মিত্র। ভাটপাড়া উপনির্বাচনে তিনি প্রার্থী। ঠিক চার বছর আগে, বেঙ্গল টাইমসে একটি দুরন্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছিল— আমি মদন বলছি। লিখেছিলেন রবি কর। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা, অসাধারণ এক রম্যরচনা। সময় বদলেছে, চারপাশের ছবিটাও বদলেছে। তবু, এখনও সেই লেখা পড়াই যায়। বেঙ্গল টাইমসে পুরনো সেই লেখা আবার বেঙ্গল টাইমসে ফিরিয়ে আনা হল। )
২৩ জানুয়ারির সারা দেশ যখন নেতাজিকে স্মরণ করছে, তখন মদনবাবুর দিন কাটছে জেলের কক্ষে। কড়া নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে সাংবাদিকরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। যদি, শুধু আজকের দিনটার জন্য সাংবাদিকরা তাঁর কাছে যেতে পারতেন, কী বলতেন তিনি? কীভাবে স্মরণ করতেন নেতাজিকে? অনুমান করলেন রবি কর।
বেইমান! বেইমান! সব শালা বেইমান! শহর জুড়ে পতাকা উড়ছে, লজেন্স- জিলিপি খাওয়া হচ্ছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে (ওফ কত কিছু মিস হয়ে গেল রে। দিদি দেবকে বিবেকানন্দ বা্নাল, ভেবেছিলাম আমি–।
সবাই ফুর্তি করছে। নেতাজি অমর রহে, ভুলছি না ভুলব না বলে স্লোগান তুলছে। আর আমি! আমার কথাটা কারও মনেই পড়ছে না। যে ক্লাবগুলোকে টাকা পাইয়ে দিলুম তাঁরাও কিনা ভয়ের চোটে আমার আমার নাম মুখে আনছে না! গত মাসেই আমার জন্মদিন গেল, না একটা পতাকা, না একটা লজেন্স। বলছে, কী করব দাদা, তোমার নাম নিলেই ভাববে সারদার টাকায় ২৩ জানুয়ারি পতাকা তুলছি। তখন সিদ্ধিনাথ ভাগ ভাগ করতে শুরু করবে। ক্লাবগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম, পুলিসের আক্কেল কী? আজকের দিনটাতে জেলে যে পতাকা তোলা হল, কেউ আমাকে পতাকাটা তুলতেও বলল না, চিফ গেস্ট করেই দায় সারল। ভাবা যায়, আলিপুর এলাকায় ২৩ জানুয়ারি পতাকা উঠছে, আমি প্রেজেন্ট, অথচ পতাকা তুলছে অন্য লোক! একটা বক্তৃতা অবধি দিতে দিল না। অথচ একটা চান্স যদি দিত, জলের মতো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতাম নেতাজি কীভাবে বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে, সিন্ধুর তলা দিয়ে জাপান চলে গেছিলেন।
সিন্ধুর তলা বলতে মনে পড়ল, নেতাজি যে ডুবোজাহাজে চড়ে জাপান গেল, এটা তো একরকম ডুব দেওয়া নাকি? আত্মগোপন করার জন্য গভীর জলে ডুব দেওয়া। এজন্য সবাই নেতাজিকে ধন্য ধন্য করে। অথচ আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি হলাম, তখন সবাই বলল, আমি নাকি ডুব দিয়াছি। আত্মগোপন করছি। কী নিন্দা, কী সমালোচনা। সন্ধেবেলায় সেজেগুজে সবাই টিভিতে বসে গেল! পাব্লিক মাইরি এইরকম। নেতাজি করলে ধন্য ধন্য, আমি করলেই জঘন্য। অথচ, আমি প্রতি পদক্ষেপে নেতাজিকে অনুসরণ করি। কী ভাবে? দাঁড়ান, বুঝিয়ে বলি।
একেবারে জন্ম থেকে শুরু করি। আমার জন্ম কোথায়? ভবানীপুরে। নেতাজির কোথায়? ওই ভবানীপুরেই। নেতাজি যদি ভবানীপুরের কৃতী সন্তান হয়, তবে আমিও তাই। নেতাজি ছাত্রাবস্থায় এক অধ্যাপককে পিটিয়েছিলেন। আমিও, মানে আমি নিজে পেটাইনি, কিন্তু যে পেটায় তাঁকে ‘তাজা ছেলে’, ‘যুব মশাল’ বলে উৎসাহ দিই। তারপর ভাবুন নেতাজি পরিবহণের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলেন। ঘোড়া, ট্রেন, জাহাজ, ডুবোজাহাজ, উড়োজাহাজ, কিসে না উঠেছেন। আমিও তো পরিবহন…, থাক দুঃখের কথা।
নেতাজি কংগ্রেস ভেঙে অন্যদল গঠন করেছিলেন। আমরাও দল ভেঙে অন্য দল গড়েছি। মূল কথা নেতাজির বিরুদ্ধে দিল্লি চক্রান্ত করেছিল। আমার বিরুদ্ধেও করছে। তারাই তো বিনা দোষে আমাকে জেলে পাঠাল। নেতাজি গড়েছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী। সেই আদর্শকে সামনে রেখেই আমিও গড়েছিলাম ট্যাক্সি ইউনিয়ন। নেতাজির নামে এয়ারপোর্ট হলে আমার নামে একটা ট্যাক্সিস্ট্যান্ড হতেই পারে।
ভেবেছিলাম, নেতাজি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন, তাই আমি প্রেসিডেন্সি জেলে থাকব। এমন ষড়যন্ত্র যে আমাকে ঢুকিয়ে দিল আলিপুর জেলে। যাই হোক এই জেল থেকেই আমি নিজেকে নেতাজির মতো করে গড়ে তুলব। নেতাজিও তো জেল খেটেছিলেন। এই পাশের জেলেই ছিলেন। রাজনীতি করতে গেলে জেল খাটতে হয়, এতে লজ্জার কিছু নেই। সাংবাদিকদের অত নাচানাচি করারও কিছু নেই। বিখ্যাত হলে একটু স্ক্যান্ডেল থাকে। নেতাজিরও ছিল, আমার থাকাটাও স্বাভাবিক। যে মহিলার সঙ্গে নেতাজির সম্পর্কের কথা বলা হত, তাঁর নাম এমিলি। আমার সঙ্গে যাঁকে জড়ানো হয়েছিল, তার নামও তিন অক্ষরে, কী আশ্চর্য, তার নামের শেষেও ‘লি’। এরপরেও বলবেন, আমাদের মধ্যে মিল নেই!
আমি যখন জেল থেকে বেরোই, কোর্টে ঢুকি তখন এমন জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ স্লোগান ওঠে না, কী বলব, নিজেকে কেমন একটা মনে হয়। ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয়, আমিই নেতাজি’। যেন আমি ত্রিপুরি কংগ্রেস থেকে ফিরছি পট্টভি সিতারামাইয়া থেকে শুরু করে সিতারাম ইয়েচুরি সবাই আমার পিছনে লেগেছে। (আচ্ছা ত্রিপুরি জায়গাটা কি ত্রিপুরায়? আসলে জায়গাটার নামি কোনওদিন শুনিনি। আমাদের দলের টিকিটে অনেকগুলো মাস্টার-ডাস্টার জিতেছে, তাদেরই কে একজন এই শব্দগুলো বলছিল।)
জেল থেকে ফিরে মাথাটা ঠাণ্ডা হলে বুঝি, আমি অনেক ক্ষেত্রে নেতাজিকেও ছাপিয়ে গেছি। কীভাবে ? আবার সেই জন্ম থেকেই শুরু করি। জিজ্ঞেস করুন, নেতাজির বাড়ি কোথায়। অনেকে দেখাতে পারবে না। আপনাকে বলতে হবে, আইনক্সের উল্টোদিকে, তবে লোকে দেখিয়ে দেবে। আর আমার বাড়ি খুঁজতে এমন কোনও ল্যান্ডমার্ক লাগে না। নামটাই যথেষ্ট। ট্যাক্সিতে উঠলে ট্যাক্সিওয়ালা ভাড়া নাও নিতে পারে। নেতাজির নাম বললে কোনও ডিসকাউন্ট পাবেন ? চেষ্টা করে দেখুন।
নেতাজি যে সব কাজ করেছিলেন, সেই সব কাজ শুধু নিজে করি না, অন্যকে করতে উৎসাহিত করি। মাস্টার পেটানোর কথা তো আগেই বলেছি। তারপর ধরুন, নেতাজি গোপনে গাড়িতে চেপে পালিয়ে গেছিলেন। আমিও একজনকে বলেছিলাম, গাড়িতে চেপে পালিয়ে যাও কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু…।
আবার দেখুন, নেতাজির সময়েও তো বড় বড় খেলোয়াড় ছিল, অভিনেতা ছিল, কবি ছিল। গোষ্ঠ পাল, শিশির ভাদুড়ি, রবীন্দ্রনাথ,নজরুল এঁরা কেউ নেতাজির সমর্থনে পথে নেমেছিলেন? রবীন্দ্রনাথ একটা নাটক উৎসর্গ করলেন, নজরুল দুটো গান লিখলেন, ব্যস! আর আমার জন্য! সুবুদ্ধি সরকার, বৃন্দনীল সেন, ত্রিবান্দম শীল সবাই রাস্তায় নামল। ভৌতম সরকার, গোষ্ঠ পালের মূর্তি থেকে ধর্মতলা অবধি মিছিল করল। কাছেই তো নেতাজির মূর্তি, নেতাজি যদি দেখতে পেত, চমকে উঠত (কী জানি, হয়ত মনে মনে আমাকে ঈর্ষাও করত।
নেতাজির মতো আমিও কিন্তু বাংলাকে ভালবাসি (তবে নেতাজির বাংলা আর আমার ‘বাংলা’ অবশ্য এক নয়)। আজ সন্ধ্যায় গলায় কিছু ঢালা যাবে কি না কে জানে? দিনকাল ভাল নয়, ঢালতে গেলে কোনও খবরওয়ালা কোথা থেকে জানতে পেরে লিখে দেবে। তখন নতুন করে কেলো। আমার জন্য জেলে কমোড বসেছে এ খবরও শালারা জেনে গেছে।
তবে আমি বলে রাখছি, ইতিহাস আমাকে মনে রাখবে। সেখানে কোনও ষড়যন্ত্র চলবে না। শ্যামবাজারের মোড়ে নেতাজির ঘোড়ায় চড়া মূর্তি আছে। রাধাবাজারের মোড়ে আমার প্রিয় জিনিস হাতে আমার মূর্তি একদিন বসবেই বসবে। কোর্টে যাচ্ছি, আর জামিন নাকচ হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে একটা বইয়ের কথা, ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নাই’। আমিও ফিরতে চাই না। একদিন সবাইকে বলতে হবে, ‘মদন ঘরে ফেরে নাই।’