আমাদের স্কুলে প্রতিবছর রি-ইউনিয়ন হয়। প্রতিবছরই যাই, HKS স্যারকে দেখি আর মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ ঘুরপাক খায়। কোনও কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ নয়, কারণ একটু আধটু দুষ্টুমি না করলে ছোটবেলা নামক বস্তুটির প্রতি অবিচার করা হয়। অপরাধবোধ এই জন্য যে, এত বড় হয়েও স্যারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মত সৎ সাহস অর্জন করতে পারলাম না।
ঘটনাটা তা হলে বলেই ফেলি। অন্যদের কতটা হাসি পাবে জানি না, কিছু জিনিস নিজে না দেখলে কেবল পড়ে বোঝা মুশকিল। সেটা ছিল ১৯৯৪ সাল ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবসে ক্লাসে ঢুকলেন কেমিস্ট্রির স্যার HKS. ঢুকেই কেন জানি না তাকালেন আমার দিকে।
সেই যে নজরুলের কবিতা আছে না ‘পড়বি পড় মালির ঘাড়ে,’ আমার হল সেই দশা। একে কেমিস্ট্রি, তায় HKS. কেমিস্ট্রি জিনিসটার মিস্ট্রি আমি কোনও দিনই বুঝে উঠতে পারিনি, রসায়ন না বলে বলতাম কষায়ন। কষা মানে চাবুক। ঠিক তেমনই HKS-এর রহস্য উদ্ধার করতে পারিনি। কখন হাসবেন, কখন রাগবেন তা কেউ জানে না। আমাদের ফার্স্ট বয় গৌতম, আপাদমস্তক ভালো ছেলে, সেও একদিন প্যাঁদানি খেয়ে গেল। স্যারের পড়ানো যখন সবার এককান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, গৌতম তখন মন দিয়ে পড়া শুনছিল। মনোযোগের চোটে তার পা দুলছিল, HKS হঠাৎ তাকে ধুমধাম মারতে শুরু করে দিলেন। বললেন, “ডেঁপঅ ছেলে, পা দোলানো! এতা কি বাবার বইঠকখানা!”
এহেন HKS স্যার ক্লাসে ঢুকে বললেন, “আজ শিক্ষক দিবস, আজ তোরাই পড়া, আমি শুনি। কঠিন কিছু নয়, হাইড্রোজেনটাই পড়া। ” তার পরেই পড়বি পড় মালির ঘাড়ে, মানে আমার ঘাড়ে। বন্ধুরা চিরকালই বেইমান, সমস্বরে বলল, “হ্যাঁ স্যার ও খুব ভালো কেমিস্ট্রিতে।” বন্ধুরা কিন্তু মিথ্যা বলেনি। তারা জানত, হাইড্রোজেনটা আমার ভালই জানা আছে। HKS যেভাবে কথা বলেন, যেভাবে দাঁড়ান, হুবহু নকল করে আমি অনেকবার হাইড্রোজেন পড়িয়ে দেখিয়েছি। আজ তারা সেই অভিনয় আরও একবার দেখার লোভে, দ্বিগুন মজার লোভে আমাকে ঠেলে দিয়েছে বাঘের মুখে।
বন্ধুদের বেইমানি দেখে আমারও মাথায় রোখ চেপে গেল। যা হয় হবে, আজ কেলেঙ্কারি বাঁধাব। স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে অবিকল স্যারের গলায়, “সাদা ধোঁয়া উৎপন্ন হয়, সাদা ধোঁয়া” “প্রবল বিস্ফোরণ” সব কিছু পড়িয়ে গেলাম। এমনকি সুরজিত পা দোলাচ্ছিল বলে তাকে “ডেঁপঅ ছেলে” বলে ধমকও দিলাম।
পড়ানো শেষ হতে স্যার “ভালো হয়েছে” বলে বেরিয়ে গেলেন। বন্দুরা আমাকে বীরের সম্বর্ধনা দিল। আমার ছাতি ফুলে ৫৬ ইঞ্চি। তোরা তো আমায় বিপদে ফেলতে চেয়েছিলিস। দেখ কেমন দিলাম।
কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। সেটা টের পেলাম কয়েক মাস পরে। ফাইনাল পরীক্ষায় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির সময় A.D. স্যার বললেন, “এই ময়ূখ, গান কবিতা সবাই পারে। তুই নাকি স্যারদের নকল করতে পারিস ? আমি কেমন করে কথা বলি দেখা।“
ময়ূখ নস্কর, প্রাক্তন ছাত্র, নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস