এই দেশ মহিলা প্রধানমন্ত্রী দেখেছে সেই ছয়ের দশকে। এই মুহূর্তে দেশের রাষ্ট্রপতি একজন মহিলা। আমাদের তিন পড়শি দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাতেও নানা সময়ে মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান দেখা গেছে। মহিলারা মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছেন। ‘অপারেশন সিন্দুর’ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, বিনোদন, খেলা— সব বিভাগেই মেয়েরা লড়ছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
এবার মেয়েদের ক্রিকেটেও ভারতের মাথায় উঠল বিশ্বজয়ের মুকুট। আগে দু’বার ফাইনালে উঠলেও শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা এই প্রথম। নিছক একটি ট্রফি নয়, এই কাপ জয়ের তাৎপর্য আরও অনেক বেশি। তিরাশির বিশ্বকাপ যেমন গোটা দেশে ক্রিকেটের জোয়ার এনেছিল, মহিলাদের এই বিশ্বজয়ও হয়তো ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল।
কিন্তু তারপরেও কিছু প্রশ্ন, কিছু সংশয়। শহরে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার হয়তো চল রয়েছে, কিন্তু গ্রাম বা মফস্বলে একজন মেয়ের পক্ষে ক্রিকেট ব্যাট হাতে তুলে নেওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। এই দলের যাঁরা তারকা, সেই হরমনপ্রীত কাউর, স্মৃতি মানধানা, রিচা ঘোষ— সবাইকেই ছেলেদের সঙ্গে খেলেই উঠে আসতে হয়েছে। ছোট শহর বা মফস্বলে মেয়েদের আলাদা দল তৈরি হবে, এই ছবিটা এখনই দেখা যাচ্ছে না।
এবার আইসিসি একধাক্কায় পুরস্কারমূল্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এর বাইরে ফারাক অনেকটাই। একসময় দেশের হয়ে খেললে ম্যাচপিছু মাত্র হাজার টাকা পেতেন ক্রিকেটাররা। এখন দেশের হয়ে খেলার ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলাদের পারিশ্রমিক সমান। কথাটা শুনতে ভাল। কিন্তু দেশের হয়ে কতটুকুই বা খেলার সুযোগ রয়েছে? মিতালি রাজ ও ঝুলন গোস্বামী। ভারতীয় ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তিই প্রায় দুই দশক ধরে দেশের হয়ে খেলেছেন। অথচ, তাঁরা দুজনেই মাত্র ১২টি করে টেস্ট খেলেছেন। বোর্ডের গ্রেডেশনেও পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ছেলেদের আইপিএল এবং মেয়েদের ডব্লুপিএল। দুই লিগের মধ্যেও বৈষম্য মারাত্মক। মেয়েদের নিলামে সর্বোচ্চ দর দু’কোটিরও কম। আর ছেলেদের নিলামে সেটাই ২৭ কোটি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ফলে হরমনপ্রীত, স্মৃতি, সেফালিদের কাছে অনেক বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব হয়তো আসবে। কিন্তু সেই পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে ছেলেদের সঙ্গে অনেকটাই ব্যবধান থেকে যাবে।
উপরতলার কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান দেখলে মনে হবে ছেলে ও মেয়েদের ক্রিকেটে অনেকটাই সাম্য রয়েছে। কিন্তু যত নীচের দিকে নামবেন, বৈষম্য যেন ততই প্রকট। শুধু দেশের বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটকে আরও বেশি করে মর্যাদা দিতে হবে। জেলায় জেলায় আরও অনেক প্রতিভা ছড়িয়ে আছে। তাঁদের আরও যত্ন নিয়ে তুলে আনতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটেও পারিশ্রমিক যেন আরও বাড়ানো হয়। এই দুরন্ত সাফল্যের পর সরকারিস্তরে কৃতী খেলোয়াড়দের কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে। এই দুরন্ত সাফল্যের পর টিভি সম্প্রচারের সুযোগ যেমন বাড়বে, তেমনই নতুন নতুন স্পনসরও বাড়বে। এই সুযোগটাকে ভারতীয় বোর্ড যেন ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারে। একটা জয় রাতারাতি সাম্য এনে দেবে, এতখানি আশা করাটা বাড়াবাড়িই হবে। কিন্তু বৈষম্য যতটা সম্ভব কমিয়ে মেয়েদের ক্রিকেটকে আরও পাদপ্রদীপের আলোয় আনার জোরালো চেষ্টার শুরুটা হোক এখন থেকেই।
