স্বরূপ গোস্বামী
চোট কখনও ছিটকে দেয়। আবার চোট কখনও দরজা খুলেও দেয়। যে কোনও জোরে বোলারের জীবনেই চোট যেন ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার’ হয়ে দেখা দিয়ে যায়। একজন স্পিনার বা একজন ব্যাটসম্যান যত না চোট পান, একজন জোরে বোলারের চোট পাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
গত কয়েকবছরের পরিসংখ্যানে একবার চোখ বোলানো যাক। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল, চেতেশ্বর পুজারাকে চোটের জন্য যত না বসতে হয়েছে, যশপ্রীত বুমরা, হার্দিক পান্ডিয়া বা মহম্মদ সামিকে চোটের জন্য মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে অনেক বেশি। আশিস নেহরা সম্পর্কে একটা চালু কথা। তিনি নাকি বাথরুমে গেলেও চোট পেয়ে ফেরেন। বেশ কয়েকমাস অনিশ্চিত হয়ে যান। আপাতত চোটের কবলে দীর্ঘদিন রয়েছেন মহম্মদ সামি। এই লেখার বিষয় তিনিই।
গতবছর দেশের মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপের কথাই ধরুন। প্রথম চার ম্যাচে তাঁকে দলে রাখাই হয়নি। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ সিরাজদের সঙ্গে জোরে বল করতে দেখা যাচ্ছিল হার্দিক পান্ডিয়াকে। আচমকাই চোট পেয়ে বসলেন। প্রথমে বলা হল, পরের ম্যাচে খেলতে পারবেন না। কয়েকদিন পর জানা গেল, সেমিফাইনাল থেকে খেলবেন। পরে দেখা গেল, সেমিফাইনাল তো নয়ই, এমনকী ফাইনালেও মাঠের বাইরে। কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষ মাস। যে সামিকে এতদিন রিজার্ভ বেঞ্চে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হচ্ছিল, তিনি দলে ফিরেই পরের সাত ম্যাচে নিলেন ২৪ উইকেট। একটি বিশ্বকাপে এত উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব আর কোনও ভারতীয় বোলারেরই নেই। প্রথম চার ম্যাচে খেলানো হলে উইকেট সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছতো! হয়তো তিরিশ ছাপিয়ে যেত। কিন্তু সবরমতীর তীরে এসেও যেন তরী ডুবল। ফলে, সামিকে ট্র্যাজিক হিরো হয়েই থেকে যেতে হল।
তার ঠিক চার বছর আগের কথাই ধরুন। ২০১৯ এ বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ইংল্যান্ডে। সেবারও প্রথমদিকের ম্যাচগুলোতে সামিকে খেলানোই হয়নি। যখন সুযোগ এল, প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক, পরের ম্যাচে পাঁচ উইকেট। তৃতীয় ম্যাচে আবার চার উইকেট। অর্থাৎ পরপর তিন ম্যাচে নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেবার সেমিফাইনালে খেলানোই হয়নি এই জোরে বোলারকে। কিন্ত তাঁকে বাদ দেওয়া হলেও তোলপাড় হয় না, প্রশ্নের ঝড় ওঠে না। তাঁর দুরন্ত সাফল্যের পরেও তাঁকে নিয়ে মাতামাতি হয় না। হয়তো গা সওয়া হয়ে গেছে। দিন কয়েক আগে, কিছুটা অভিমান করেই বলেছিলেন, আগের বিশ্বকাপে আমি ৩ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়েছিলাম। এবারও ৭ ম্যাচে নিয়েছি ২৪ উইকেট। একজন জোরে বোলারের কাছ থেকে এক থেকে বেশি আপনারা কী আশা করেন?
অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে তাঁর জীবনের ওপর দিয়ে। নিজেকে যতটা সম্ভব, আড়ালেই রাখেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তেমন সক্রিয় নন। বিতর্ক থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকারই চেষ্টা করেন। বারবার বঞ্চনার শিকার হলেও ক্ষোভ উগরে দিতে বা অন্য কাউকে দোষারোপ করতে দেখা যায় না। আটমাসের বেশি সময় ধরে চোটের কবলে। জাতীয় দলের আঙিনা থেকে অনেকটাই দূরে। এমনকী আইপিএলেও খেলতে পারেননি। একাকী তাঁর দিন কাটছে বেঙ্গালুরুর এনসিএ–তে। নিঃশব্দে চলছে ফিরে আসার লড়াই। সারাক্ষণ ছবি সাঁটিয়ে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখার ঝোঁক নেই। ‘ফিরে আসছি’ এমন বার্তা দেওয়াও নেই। নেটে দু এক ওভার হাত ঘোরাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু স্বাভাবিক ছন্দ থেকে এখনও হাজার মাইল দূরে। ফিরতে হলে, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেই ফিরতে হবে। অর্থাৎ, দীর্ঘদিন পর আবার বাংলার জার্সি গায়ে রনজি খেলবেন। ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সিরিজে ফিরলেও ফিরতে পারেন।
গত একবছরে লম্বা সময় চোটের কবলে কাটাতে হয়েছে বুমরা, হার্দিককেও। তাঁরা স্বমহিমায় ফিরেছেন। হয়তো সামিও ফিরবেন। কিন্তু বারেবারে চোট যে কেড়ে নিয়েছে অনেকটা সময়। সেই কপিলদেব। তারপর একশো টেস্ট খেলার সুযোগ হয়েছিল একমাত্র ইশান্ত শর্মার। ভারতের আর কোনও জোরে বোলার কি একশো টেস্টের মাইলস্টোন পেরোবেন? প্রতিভা ঠিল, সম্ভাবনা ছিল, সাফল্যও ছিল— এমন বেশ কয়েকটা নাম গড়গড় করেই বলা যায়। কিন্তু ওই যে চোট! অনেককেই এই মাইলস্টোন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাই আর কোনও জোরে বোলার একশো টেস্ট খেলবেন, এমন আশা না রাখাই ভাল।