ঋষভ সোম
শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া যাক, দীর্ঘদিন ধরেই দেব সম্পর্কে একটা নাক উঁচু ভাব ছিল। দেব মানেই আমার কাছে ছিল পাগলু, খোকাবাবু, চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি ইত্যাদি। হলে গিয়ে তাঁর সিনেমা দেখব, পাঁচ বছর আগেও বোধ হয় এমনটা ভাবিনি। টিভিতে চ্যালেল সার্ফিং করতে গিয়ে যা দু–এক ঝলক চোখে পড়েছে, তাতেই বিরক্তি চরমে পৌঁছত। হয়ত তাই, চাঁদের পাহাড় অন্যরকম ছবি জানার পরেও হলে দেখিনি। অ্যামাজন অভিযানও দেখিনি। এমনকী টিভিতে খাপছাড়া দেখার পরেও সেভাবে মনে দাগ কাটেনি।
দেবের দুটো ছবি হলে গিয়ে দেখেছি। একটা ককপিট। অন্যটা সাঁঝবাতি। দুটোই একটু অন্যরকম লেগেছে। বিশেষ করে সাঁঝবাতিতে পেয়েছিলাম একেবারেই অন্য এক দেবকে। যে দেবকে দেখে একটু একটু করে ভরসা করা যায়। কোন টানে জানি না, টনিকও দেখেই এলাম। যত না দেবের টানে, তার থেকেও বেশি পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের টানে। দেবের আরও একটা ছবি আছে, পরান যায় জ্বলিয়া রে। নামটা আর গানটা শুনলেই অদ্ভুত একটা রাগ হত। এবারও দেবের সঙ্গে জড়িয়ে গেল পরান। তবে এই পরান যেন আগুনের পরশমণি। বড়দিনের আবহে প্রাণে একটুকু ছোঁয়া দিয়ে যান।
কেন জানি না মনে হয়, এই প্রবীণ অভিনেতাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতেই পারল না টলিউড। কৌশিক গাঙ্গুলি তাঁর ‘সিনেমাওলা’য় এই প্রবীণ অভিনেতাকে কেন্দ্র করেই চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন। বর্ষীয়ান অভিনেতাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর ওপর ভরসা রাখলে এই বয়সেও তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন।
টনিকজুড়ে অদ্ভুত একটা রসায়ন। এতদিন দেবের জুটি বলতে কোয়েল, মিমি, শ্রাবন্তীদের বুঝতাম। এবার দেবের সঙ্গে জুটি পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অসম বয়সের একটা জুটি। কেন জানি না, মনে দাগ কেটে গেল। এখানে নায়িকার কোমর ধরে নাচ নেই। গুন্ডা পেটানো নেই। অকারণে একটা নাচের দৃশ্যের জন্য বিদেশ ভ্রমণ নেই। বরং, ঘরের কাছের উত্তরবঙ্গ ধরা দিয়েছে একেবারে অন্য মেজাজে। সেদিক থেকেও দেবের এক অদ্ভুত বিবর্তন।
বার্ধক্য মানুষকে আরও নিঃসঙ্গ করে তোলে। চারপাশের পৃথিবীটা কেমন যেন বিরক্তিকর মনে হয়। নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে একটা নাক সিঁটকানো ভাব এসে যায়। কিন্তু এই ছবি দেখিয়ে দিল, এই বয়সেও নতুন করে ইনিংস শুরু করা যায়। গুটিয়ে থাকা একটা মানুষও দিব্যি অ্যাডভেঞ্চারে নেমে পড়তে পারেন। শুধু দরকার একটু সাহস। মানে, একটু টনিক। আড়াল থেকে দেব ঠিক সেটাই করেছেন।
নিজে একজন ব্লকব্লাস্টার নায়ক। নিজেই পরিচালক। ইচ্ছেমতো স্ক্রিপ্ট লেখাতে পারতেন। সেখানে নিজেকে ব্যাক গিয়ারে রেখে বর্ষীয়ান পরান বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘আসল হিরো’ করে তুলতে হিম্মৎ লাগে। অদ্ভুত একটা সংযম লাগে। দেব সেই হিম্মৎ ও সংযম দুটোই দেখিয়েছেন।
এতদিন মনে করতাম, দেবের ছবি ছেলে ছোকরাদের জন্য। পরিবারের সঙ্গে দেখা যায় না। বয়স্কদের সঙ্গেও না। কিন্তু কেন জানি না মনে হচ্ছে, এই ছবি বয়স্কদের অবশ্যই দেখানো উচিত। তাঁরাও যদি একটু হলেও বাঁচার নতুন ইচ্ছেশক্তি ফিরে পান, মন্দ কী? এই টনিক নিছক পর্দায় আটকে নেই। ঢুকে পড়তে পারে বাড়িতে বাড়িতে, মনে মনে।