‌‌যতক্ষণ পারেন ফেসবুক থেকে দূরে থাকুন

ইন্দ্রাণী রাহা

কিছু দিন আগেই ফেসবুকের এক অ্যাপ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কারণ সেখানে পরিচয় গোপন রেখে অ্যাপাধিকারীকে বার্তা বা মেসেজ পাঠানো যায়। অ্যাপটির জনপ্রিয়তা লাভ করার দুটি কারণ ১) বার্তা প্রেরণকারীর নিজের পরিচয় গোপন রাখা যায়। ২) বার্তা গ্রহণকারী বা বলা ভালো অ্যাপাধিকারীর বার্তা বা ম্যাসেজ পছন্দ না হলে তিনি স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট না করতেই পারেন, কেউ এই বিষয়ে কিছু জানতে পারবে না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রেম নিবেদন থেকে শুরু করে মান–‌অভিমান, এমনকী সমালোচনা থেকে শুরু করে ক্ষোভ সবকিছুই উগরে দেওয়ার দারুণ সুযোগ আড়ালে থেকে বা পরিচয় না জানিয়ে, আপামর জনসাধারণ এককথায় লুফে নেয়।


আর ঠিক এখান থেকেই আপনার অনুভূতিগুলোকে ব্যবহার করে আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে স্যোশাল মিডিয়ায় আটকে রেখে কোটি কোটি টাকার মুনাফা ঘরে তুলছে আর এক দল। আপনিও নিজেকে ট্রেন্ডি বা আপডেটেড রাখার জন্য মন ভাসাচ্ছেন চলতি জোয়ারে আর নিজেদের অনুভূতিগুলোকে আলগা করে দিচ্ছেন, নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলছেন নিজের মনের খেই।

একবারও ভেবে দেখেছেন এই সব সমাজ তথা স্যোশাল মিডিয়া উত্তাল করা অ্যাপ আসলে ঠিক কী উত্তাল করে তোলে…? উত্তরটা হল সাধারণ মানুষ তথা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মন। ফলস্বরূপ ‘‌ভাল্লাগে না’‌ রোগ, রাতজাগা ও মাঝরাতে ক্ষিদে পাওয়ার বদ অভ্যেস। এবং এই নিয়ে একটি অসাধারণ আত্মতুষ্টি আছে। বর্তমান যুব সমাজের ধারণা, এই সব রোগ আঁতেল (গালাগালি নয়, বরং কলার তুলে আদিখ্যেতা) হওয়ার লক্ষণ, বুদ্ধিজীবী বা ইন্টেলেক্টদের লাইফস্টাইল এইরকমই হয়, কারণ তারা ক্রিয়েটিভ বা সৃষ্টিশীল মানুষ। আর এই ক্রিয়েটিভিটির নাম করে মিডিওসিটি বা মধ্যমেধার সস্তা চাটুকারিতা আজ সামাজিক পরণনত মনষ্কতার মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোনও মানুষের প্রতি রাগ, দুঃখ, অভিমান তথা প্রেম বা আসক্তি যা-ই থাকুক না কেন, নিজেকে আড়ালে রেখে নিজের সেই অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে গেলেন এবং তা স্যোশাল মিডিয়ায় ঢেলে দিলেন। ওদিকে অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটি নিজের সুবিধামতো তা প্রকাশ করবেন নিজের প্রতিক্রিয়া–‌সহ। এবার তা প্রকাশিত হলে আপনার মন আকাশে উড়বে, আর প্রকাশিত না হলে আপনি মনে মনে গুমরাবেন।
একবারও ভেবে দেখেছেন, এই সমস্ত অনুভূতিগুলো, পরিচয় গোপন করে প্রকাশ করতে হচ্ছে কেন?

আপনার সৎ সাহস নেই?‌ নাকি অনুভূতিগুলির সততা নেই? অর্থাৎ আপনার কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভ আছে, আদৌ সেই রাগ বা ক্ষোভের কোনও উচিত কারণ আছে তো, নাকি সেটা হিংসা?
কারোর প্রতি তীব্র অভিমান… আচ্ছা, সেই অভিমান করার মতো অধিকার কি আছে? আপনি চাইলেই তো আর অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটির ওপর অধিকার পেয়ে যাবেন না। এক্ষেত্রে তার মতামত কিন্তু সমান গুরুত্ব পায়। আপনার প্রেম বা ভাললাগা অপর মানুষটির কাছে অনধিকার বা অনুচিত হতে পারে!

অপরদিকে এই জাতীয় অ্যাপাধিকারী যিনি আপামর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পরিসর দিচ্ছেন কারণ তিনি ‘‌নিজের সম্পর্কে জনগণের মনোভাব খোলাখুলি জানতে চাইছেন’‌— এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এক্ষেত্রে তিনি নিজের পছন্দমতো বার্তা বা মেসেজগুলি বেছে বেছে প্রকাশ্যে আনছেন। এ এক অসাধারণ হিপোক্রেসি। নিজের সমালোচনা গ্রহণ করা বা জনগণের তাঁর প্রতি মনোভাব গ্রহণ করার মতো মানসিক দৃঢ়তা এদের নেই।

এরপর একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো, ফেসবুকে আপনার মনের ঠিক কোন দিকটি চর্চিত হচ্ছে ? ঠিক কোন অনুভূতিগুলি প্রাধান্য পাচ্ছে…? ফেসবুকে পাতার পর পাতা জুড়ে গোপন হিংসা, হীনমন্যতা, ভন্ডামি থেকে অনধিকার বা অনুচিত চাহিদার চর্চা চলছে। দিনের শেষে আপনার নিজের মানসিক সুস্থতার দায় কিন্তু আপনারই। অ্যাপ দু–‌দিন এসে আপনার অনুভূতিগুলি ব্যবহার করে কোটি কোটি মুনাফা লুটে চলে যাবে। দিনের শেষে আপনার ভুল/ খারাপ অনুভুতি বা নেগেটিভ ইমোশনস্ গুলো নিয়েই তাদের ব্যবসা। ব্যবহৃত হচ্ছে আপনার মন, আপনার অনুভূতি আর আপনার ডিপ্রেশন বা ভাল্লাগেনা নামক মারাত্মক রোগটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হল, আপনি যত ডিপ্রেশন বা ‘‌ভাল্লাগে না’‌ রোগে ভুগবেন, তত এই সমস্ত অ্যাপ এর পাল্লায় পড়বেন। আর তত এদের বাড়-বাড়ন্ত হবে।

এককথায় ফেসবুক থেকে লগ-আউট হয়ে যান। যতক্ষণ পারেন ফেসবুক থেকে দূরে থাকুন।
‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.