কুন্তল আচার্য
সেই আটত্রিশ বছর আগের কথা। স্মার্টফোন হাতে ঘোরা আস্ত একটা প্রজন্মের তখন জন্মও হয়নি। যাঁদের কমতে থাকা চুলের ফাঁকে মাঝবয়সের সংস্কৃতি উঁকি মারে, তাঁরাও তখন নেহাত শৈশব আর কৈশোর যাপনে ব্যস্ত। তাদের কাছে তিরাশি মানে একটা রূপকথা। কিছুটা শোনা। কিছুটা পড়া। পুরানো ভিডিও ফুটেজে কিছুটা দেখা। কিন্তু একটা জয়ের আড়ালে এত না জানা ঘটনার ঘনঘটা, কে ভেবেছিল!
সাহিত্যের জগতে একটা চালু কথা আছে, বাস্তব কখনও কখনও কল্পনাকেও হার মানায়। ছবির ক্ষেত্রে আমরা হামেশাই গল্পের গরুকে গাছে চড়তে দেখি। বায়োপিক হলে কাউকে মহান দেখানোর একটা হিড়িক পড়ে যায়। কতরকম গল্প ফাঁদতে হয়। কত ইতিহাস বিকৃতি ঘটে। কিন্তু এখানে শুধু এখান ওখান থেকে টুকরো টুকরো মুহূর্ত জুড়ে দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। বাড়তি কোনও কল্পনার রঙ দরকার পড়েনি। কারণ, পরতে পরতে যে রোমাঞ্চ ছিল, তার মূল্য মেকি কল্পনার থেকে ঢের বেশি।
আচ্ছা, কপিলদেবের সেই ১৭৫ রানের ইনিংস দেখেছেন? একবার শুধু প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিন। তারপর উত্তরগুলো দেখে যান। কেউ বলবেন, আমাদের বাড়িতে তখন টিভি আসেনি। পাশের বাড়ির রতনকাকুদের বাড়িতে দেখেছিলাম। কেউ বলবেন, ওই ইনিংসের পর আমরা ফিস্ট করেছিলাম। কেউ বলবেন, আমরা সোফায় এমন জোরে লাফিয়েছিলাম, সোফাটাই ভেঙে গিয়েছিল। মোদ্দা কথা, সবাই প্রত্যক্ষদর্শী হতে চান। ‘দেখিনি’ বললে যদি প্রেস্টিজ চলে যায়! তাই যাঁর জন্ম হয়নি, তিনিও প্রত্যক্ষদর্শী।
আসল ঘটনা হল, সেই ম্যাচটা হয়েছিল লন্ডন থেকে অনেকটা দূরে টানব্রিজ ওয়েলস নামের এক অখ্যাত মাঠে। সেই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে ম্যাচ। তার ওপর সেদিন বিবিসির ধর্মঘট। ফলে, সেই ম্যাচের টিভি সম্প্রচার হয়নি। কোনও ভিডিও ফুটেজ নেই। স্বয়ং কপিলের কাছেও নেই। তাহলে, লোকে কেন বলে ওই ইনিংস টিভিতে দেখেছি? আসলে, কেউ কেউ ফাইনালটা দেখেছেন। সেটাকেই জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ বলে চালিয়ে দেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ওই ইনিংস এমন একটা মিথ হয়ে গেছে, অনেকেই মনে করেন, হয়ত সত্যিই দেখেছেন।
এই ছবিতেও অদ্ভুত একটা দৃশ্য। এদিকে ম্যাচ শুরু, কপিল জানেন, তাঁকে পরের দিকে নামতে হবে। তাই তিনি এই ফাঁকে স্নান সেরে নিচ্ছেন। হঠাৎ শুনলেন চার উইকেট পড়ে গেছে। তারপর সেই মহাকাব্যিক ইনিংস। সেই ইনিংস দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ কিছুটা হলেও মেটাবে এই ছবি। খেলার কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু মাঠের বাইরের গল্পগুলো ঠিক কেমন ছিল? সাজঘরে ঠিক কীভাবে কথা বলতেন কপিল? তাঁর ইংরাজি নিয়ে কীভাবে মস্করা করতেন সতীর্থরা? শুরু থেকেই কোন কোন উপেক্ষা ও অপমানের শিকার ভারতীয় দল? সেইসব দিক সুন্দরভাবেই তুলে ধরেছেন পরিচালক কবীর খান।
পরিচালক আগেই পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, একটা দলের কেউ ভাবতে পারেননি তাঁরা বিশ্বকাপ জিততে পারেন। ভেবেছিলেন শুধু একজন, কপিলদেব। তাঁর সেই বিশ্বাসটাই এই ছবির মেরুদণ্ড। এটা কি তবে কপিলের বায়োপিক? ঠিক তাও নয়। এখানে মোহিন্দার অমরনাথ থেকে মদনলাল, সুনীল গাভাসকার থেকে বলবিন্দার সিং সান্ধু সবার কথাই বেশ গুরুত্ব দিয়ে আছে। ম্যানেজার মান সিংয়ের পাশাপাশি রয়েছেন একটিও ম্যাচ না খেলা সুনীল ওয়ালসন। অধিনায়ক হিসেবে কপিলের লড়াই একটা বাড়তি স্পশ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এটা আসলে তার থেকে অনেক বেশি কিছু। কীভাবে একটা দল একটা ইতিহাস নির্মাণ করল, পর্দায় এ যেন তারই দিনলিপি।
ধোনির বায়োপিকে অনেকটাই নজর কেড়েছিলেন সুশান্ত সিং রাজপুত। কৌতূহল ছিল, রণবীর সিং কতটা কপিলদেব হয়ে উঠতে পারলেন? জোর গলায় বলা যায়, পুরোপুরি উতরে গেছেন এই অভিনেতা। মেক আপে শুধু কপিলের মতো দেখতে লাগছে, এমন নয়। তার চেয়েও কঠিন ছিল তাঁর ব্যাটিং ও বোলিং ভঙ্গিমাকে তুলে আনা। মাঠের কপিলকে তুলে আনা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। চারমাস ধরে মাঠে পড়ে থেকে সেগুলো আয়ত্বে এনেছেন। এই ফাস্টফুডের জমানায় একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে এমন নিষ্ঠা, এমন পরিশ্রম সত্যিই বিরল। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই ছবিটি তাঁর জীবনেও একটা মাইলস্টোন হয়েই থেকে যাবে।
ইতিমধ্যেই চলে গেছেন যশপাল শর্মা। বাকি অনেকেই সত্তর ছাপিয়ে গেছেন। মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে, এমন একটা বিশ্বজয়ের কাহিনী তুলে আনতে ৩৮ বছর লেগে গেল? ধোনির বিশ্বজয়ের কথা পর্দায় উঠে এসেছে। বিরাট কোহলিদের বিক্রমের কথা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে কারও অজানা নয়। কিন্তু সেই লড়াইয়ের ভিত বোধ হয় তৈরি হয়েছিল তিরাশিতে, যা একধাক্কায় ভারতীয় ক্রিকেটকে অনেকটা সাবালক করে তুলেছিল। সেই কাহিনীও উঠে আসা দরকার ছিল। থমকে থাকা বছরের শেষে সেই রোমাঞ্চটাই বড় প্রাপ্তি।