শহিদ কাদরির এই গানটা তোমাদের জন্য

দ্যুতিমান মুখার্জি

‌৯৬ এর এক শীতের সকাল। রবিবারের আলসেমি আঁকড়ে, গিরীশ মঞ্চের সিংহভাগ চেয়ার সেদিন ফাঁকা। অনুষ্ঠান শুরু করতে করতে ডাক দিলেন কবিয়াল
‘‌দিন কাল ভালো নয় বন্ধুরা, আসুন সবাই আরও কাছাকাছি থাকি’‌।
সুতরাং…
এক লাফে নিজের টিকিটের গায়ে লেখা রো নম্বরটাকে হেলায় ভাসিয়ে দিয়ে, একেবারে সটান দ্বিতীয় সারিতে। এরপর শুধু এ গান ও গান ..কতক্ষণ কে জানে, আদরের নৌকায় ভাসতে ভাসতে একসময় দ্বিতীয় সারি থেকে একটা গলা ছুটে গেল স্টেজের দিকে,
“প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাগর থেকে ফেরা.. “,

 


মুহুর্তে থেমে গেল সব। একটু নীরবতা, তারপর স্টেজ থেকে গমগম করে উঠলেন নাগরিক কবিয়াল
‘‌কে বললেন ভাই? উঠে দাঁড়ান তো, মনিশংকর, অডিটোরিয়ামের সব আলো জ্বেলে দাও’‌…
এক ঘর আলোর সামনে লজ্জায়, ভয়ে পুড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়িয়েছে এক যুবক। পাশে বসা যুবতীর মুখও তখন শুকিয়ে কাঠ।
‘‌কোথায় শুনলেন ভাই এ গান?’‌
‘‌না, মানে.. ’‌
স্মিত হাসলেন সুমন।
‘‌আজ ১৮ বছর পর, গানটা গাইবো’‌
এরপর শুরু সেই অসামান্য গান দিয়ে আরও একবার কবিতার স্নান! ১৮ বছর! কে বলে? একটা অক্ষর ভুলে যাওয়া নেই, সিন্থেসাইজারে একটা ভুল সুরে আঙুল পড়ছে না…প্রেমেন্দ্র মিত্র অলক্ষ্যে আবার চোখ মেলে চাইলেন বোধহয়। একটা সময় সেই মহা কাব্যের শেষে, তখনও দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের পাশের মেয়েটির দিকে চেয়ে হাসলেন সুমন,
‘‌আজ শহীদ কাদরির এই গানটা তোমাদের দুজনকে উৎসর্গ করলাম…অনুষ্ঠান শেষে ভেতরে এসো তোমরা দুজন’‌
তারপর, একসময় ঠিক মেঘ ছেঁড়া তীব্র আলোর মতো, সিন্থেসাইজারে, সুরে, কথায় অডিটোরিয়াম ময় নেমে আসছেন কবীর, সপাট। অক্ষরে অক্ষরে, সোজা মেরুদণ্ডে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে বাংলা আধুনিক গান, সঙ্গে ছায়ার মতো শহীদ কাদরি …
লজ্জায় রঙিন হতে হতে ছেলেমেয়ে দুটি শুনছে —
‘‌প্রিয়তমা তোমাকে অভিবাদন,
ভয় নেই এমন দিন এনে দেবো,
দেখো সেনাবাহিনী, বন্দুক নয়,
গোলাপের তোড়া হাতে
কুচকাওয়াজ করবে তোমার সামনে… ’‌
সেই যুবক যুবতীর দুজনেই আজ পঞ্চাশের দোর গোড়ায়….
তবু আজও, দুজনেই পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়লে, সেই লাল আলোয় পূবের খোঁজ করে। দুটোর রঙই তো লাল। একটা পুরনো জীবনের আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে, নতুন জীবন।
জীবন এমনই বন্ধুরা।‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *