উত্তম জানা
মা,
সেই কত বছর আগের কথা। আমি তখন হোস্টেলে থাকতাম। তুমি মাঝে মাঝেই চিঠি লিখতে। আবার হোস্টেলের ল্যান্ডফোনে ফোনও করতে। আমিও এসটিডি বুথ থেকে বাড়ির ল্যান্ড নম্বরে ফোন করতাম। কত কথা হত। তুমি ফোনে যে সব কথা বলতে, কয়েকদিন পর চিঠিতেও দেখতাম সেই একই কথা।
একদিন তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ফোনে যেগুলো বলো, সেগুলোই তো চিঠিতে লেখো। তাহলে আলাদা করে চিঠি লেখার দরকার কী? ফোনে তো কথা হচ্ছেই। তুমি ভারী সুন্দর একটা কথা বলেছিলে। সেদিন তুমি বলেছিলে (পরে লিখেওছিলে), ফোনে যেগুলো বলছি, সেগুলো আজকের জন্য। কালকেই সেই কথাগুলো ভুলে যাবি। কিন্তু যেগুলো লিখছি, সেগুলো থেকে যাবে। যখন আমি থাকব না, তখন এই চিঠিগুলো থাকবে। যখন ইচ্ছে, তখনই পড়তে পারবি। ওই চিঠির মাঝেই আমি বেঁচে থাকব।
আজ তুমি অনেক দূরে। কিন্তু এই চিঠিগুলো থেকে গেছে। মাঝে মাঝেই বের করি। পড়ি। চোখে জল চলে আসে। দুঃখে, নাকি আনন্দে, সেটা বলা খুব মুশকিল। কারণ, কোন কান্না কেন আসে, নিজে অভিনেতা হয়েও এখনও বুঝি না। প্রায় দু’দশক ধরে পায়ের তলায় একটু মাটি পাওয়ার জন্য কত লড়াই করেছি। কতবার মনে হয়েছে, এভাবে লড়াই করার থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া অনেক ভাল। পকেটে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি আছে। বাবার ব্যবসা আছে। কী দরকার একটা–দুটো খুচরো রোল পাওয়ার জন্য এত ঝক্কি নেওয়ার। কিন্তু বারবার পাশে থেকেছো তুমি। বারবার লিখেছো, এই লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাবি? এটা তো যুদ্ধক্ষেত্রও নয়। এটা অভিনয়। তাতেও এত ভয়? স্ট্রাগলটাই জীবনের আসল। একদিন সাফল্য আসবে, পরিচিতি আসবে। কিন্তু এই স্ট্রাগলটার জন্য যেন সেদিন গর্ব করতে পারিস।
কী না করতে হয়েছে। পাঞ্জাবি হয়েও কিনা ছুটে গেছি তামিল ছবি করতে। কারণ, বলিউডে আমার জায়গা ছিল না। যদিওবা একটু আধটু জায়গা হল, সেটা মোটেই সম্মানের নয়। ভিলেনও নয়, তার চামচা। হিরোর হাতে মার খাও। ঘুসি খেয়ে হয় পুকুরে গড়িয়ে পড়ো, নইলে দোকানে সাজানো হাড়ি–কলসীর ওপর দিয়ে পড়ো। তারপর এডিটিংয়ের সময় সেইসব দৃশ্য বাদ চলে যেত। কাউকে বলাও যেত না, এই সব ছবিতে আমি কাজ করেছি। বললে সে উপহাসের দৃষ্টিতেই তাকাত। মুখ বুঝে লড়ে গেছি।
বছর কুড়ি আগে, সেবার ভগৎ সিংকে নিয়ে তিনখানা ছবি বেরোলো। একটা অজয় দেবগনের, একটা ববি দেওয়ালের। একটা আমার। বাকি দুটো বেশ চলল। আমারটা একেবারে সুপার ফ্লপ। যারা দেখেছিল, তারাও নির্ঘাত কপাল চাপড়েছিল, কেন দেখলাম! আর আজ! সেই অখাদ্য ছবিটাকে লোকে ঘুরেফিরে দেখছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে খুঁজছে। হঠাৎ, ছবিটার প্রতি এত ভালবাসা গজিয়ে উঠল কেন? আসলে, গত এক–দেড় বছরে আমার পরিচিতি অনেকটা বদলে গেছে।
এই করোনা কত লোকের জীবন উজাড় করে দিল। কত মানুষ চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল। কিন্তু আমাকে নতুন একটা জীবন দিয়ে গেল। দেড় বছর আগেও দেশের আমজনতা জানত না সোনু সুদ লোকটা কে? কিন্তু আজ প্রায় সবাই জানে। কারও অক্সিজেন চাই, কারও হাসপাতালে বেড চাই, কেউ বাড়ি ফিরতে পারছে না। তারা কিনা ভেবে নিচ্ছে, আমাকে একবার জানাতে পারলে কিছু একটা সুরাহা হয়ে যাবে। এমনকী কারও জমিতে চাষ হচ্ছে না, কারও বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাচ্ছে। সেও কিনা আমার টুইটারে গিয়ে ট্যাগ করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে হাসিও পায়। আবার মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে। এত মানুষের আস্থা আমি অর্জন করেছি! সত্যি বলছি মা, তোমার কথা খুব মনে পড়ে। তুমি থাকলে আজ এই ছেলের জন্য সত্যিই তোমার গর্ব হত।
জানো, সেদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। লকডাউন। বাইরে গাড়ি চলছে না। এক মাতাল ফোন করে জানাল, ‘সোনুজি, বাইরে গাড়ি চলছে না। কতদিন ড্রিঙ্ক করিনি। বারে কী করে যাব?’ আমি বললাম, ‘এখন তো স্বাভাবিক আছো। তাই, পায়ে হেঁটে চলে যাও। ওই জিনিসটি খাওয়ার পর তো আর হাঁটতে পারবে না। তখন বরং আমাকে ফোন করবে। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’ সে লোকটা আগে একচোট হেঁসে নিল। তারপর কয়েকটা গালাগাল দিয়ে ফোন রেখে দিল।
জীবন কত বিচিত্র। কত অনুভূতির সামনে সে দাঁড় করায়! আমি এত এত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারব? কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। আচমকা লকডাউনের সময় মনে হল, এত মানুষ খেতে পাচ্ছে না। আমারও কিছু একটা করা উচিত। এক বন্ধুর সাহায্যে কয়েকজনের খাবারের ব্যবস্থা করলাম। দিন দিন লোক বাড়তে লাগল। তারপর দেখলাম, অনেকেই নিজের বাড়ি ফিরতে পারছে না। ছেলে কোলে নিয়ে, জিনিসপত্র কাঁধে নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে মানুষ। কোনও ট্রেন নেই, কোনও গাড়ি নেই। মনে হল, এঁদের যদি বাড়ি ফেরাতে পারি, কেমন হয়। নিজেই কয়েকটা বাস ভাড়া করলাম। সেই বাসে তাঁদের চাপিয়ে দিলাম। তাঁরা যে যার বাড়ির দিকে চলে গেলেন। এত লক্ষ লক্ষ মানুষ। সামান্য রোজগারের আশায় যারা এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে এসেছেন। এই কঠিন সময়ে তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়াই ছিল প্রথম ভাবনা। কিন্তু এত এত মানুষকে ফেরাব কীভাবে? আমার তো এত টাকা নেই।
কী আশ্চর্য। কত মানুষ যে পাশে এসে দাঁড়াল। কেউ বাসের ভাড়া দিতে চাইছে। কেউ খাবার দিতে চাইছে। কেউ পোশাক। তারা নিজেদের মতো করেই সাহায্য করতে পারত। কিন্তু তারা চাইল, এই কাজটা আমার হাত দিয়ে হোক। আমার হাতে এই টাকাটা তুলে দিলে নাকি সদ্ব্যবহার হবে। সেই টাকা নাকি সত্যি সত্যি গরিব মানুষের কাছে পৌঁছবে। এতখানি আস্থার মর্যাদা রাখতে পারব তো! বারবার এই ভাবনাটা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু যত দিন গেছে, ততই মানুষ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাও এখন আমার আবেদনে সাড়া দিচ্ছে। সরকারি স্তরেও সাহায্য পাচ্ছি।
আগে রিয়েলিটি শো–গুলো আমাকে পাত্তাই দিত না। কেউ ডাকত না। ডাকবে কেন? একজন তৃতীয় সারির ভিলেনকে কে ডাকবে? কিন্তু এখন এত ডাক আসছে, সামলাতে পারছি না। তারা বলতে শুরু করেছে, আমিই নাকি আসল হিরো। এর মধ্যেই আমার বায়োপিক করতে চেয়ে কেউ কেউ যোগাযোগ করছে। ভেবে দেখো, যে পরিচালকরা একসময় আমাকে কাজই দিতেন না, আজ তাঁরা কিনা আমার বায়োপিক করতে চাইছেন।
সত্যিই মাত্র দেড় বছরে জীবনটা কেমন বদলে গেল। একেবারে থার্ড গ্রেড ভিলেন থেকে রিয়েল হিরো। তোমার চিঠিগুলো বের করে পড়ি। ফোনের কথাগুলো সত্যিই ভুলে গেছি। কিন্তু চিঠিগুলো পড়তে বুঝতে পারি, তোমার চিঠিগুলো কীভাবে সাহস জুগিয়েছিল। তাই আমিও তোমাকে মাঝে মাঝেই চিঠি লিখি। জানি, সেই চিঠি কোনওদিন তোমার কাছে পৌঁছবে না। তবু লিখি। কেউ না পড়ুক, কোনও একটা সময়ে নিজে তো পড়তে পারব।
(বেঙ্গল টাইমসের শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত। এরকমই আরও অনেক আকর্ষণীয় ফিচার রয়েছে এই শারদ সংখ্যায়। )