বদলে গেল ছবির নাম। বাইশ বছরে সুচিত্রাও যে অনেক বদলে গিয়েছিলেন। লিখেছেন অভিরূপ অধিকারী।
সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি কী? প্রশ্নটা যত সহজ, উত্তরটা তত সহজ নয়। পাল্টা প্রশ্ন হতেই পারে, সুচিত্রা অভিনীত প্রথম ছবি নাকি মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি?
হিসেব অনুযায়ী, সুচিত্রার মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি সাত নম্বর কয়েদি। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সুচিত্রার প্রথম ছবির ৬৪ বছর হয়ে গেল।
তবে তারও আগে একটা অধ্যায় আছে। সেটা বেশ অবাক করার মতো। সুচিত্রা প্রথম কাজ শুরু করেন ‘শেষ কোথায়’ ছবিতে। পরিচালক ছিলেন বীরেশ্বর বসু। নায়ক ছিলেন সমর রায়। কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে। ততদিনে শ্বশুরবাড়ি থেকে অভিনয়ের ছাড়পত্র পেয়ে গেছেন রমা সেন। স্বামী দিবানাথ সেন নিজে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন রমাকে। পরিচালককে অনুরোধ করলেন, তাঁর স্ত্রীর জন্য একটা ভাল কাজের ব্যবস্থা করতে। আশ্বাস দিলেন পরিচালক। সুচিত্রার তখন এমন রূপ, এমন বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি, ফিরিয়ে দেওয়ার উপায়ও ছিল না। কাজ শুরুও হল। কিন্তু মাঝপথেই সেই কাজ থেমে গেল। ফলে ছবি মুক্তি পাওয়ার প্রশ্নই নেই।
প্রথম ছবি শেষ না হওয়ায় কিছুটা হতাশই ছিলেন রমা। কিন্তু তাই বলে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। এসে গেল আরেকটা সুযোগ। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত তাঁর প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’র জন্য নতুন নায়িকা খুঁজছেন। কথাটা মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল। রমাকে নিয়ে হাজির স্বামী দিবানাথ। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গেল পরিচালকের। তবে রমার কথায় তখনও পূর্ববঙ্গের টান। এটা কী করে কাটানো যায়?
পরিচালক বললেন, তোমার বাঙাল টান তো এই ছবিতে চলবে না। তোমাকে কিছুদিন রিহার্সাল করাতে হবে। রাজি হয়ে গেলেন রমা। তারপর কী হল, পরিচালকের লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যাক — ‘এই রিহার্সালের জন্য রমাকে সাত নম্বর কয়েদির ডায়ালগ দিইনি। দিয়েছিলাম শরৎবাবুর বিন্দুর ছেলে নাটকখানা। কারণ, আমার বিশ্বাস, শরৎচন্দ্রের চেয়ে ভাল সংলাপ লিখিয়ে আজও বাংলা সাহিত্যে কেউ নেই।
আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখলাম রমার। কয়েকদিনের মধ্যেই সে পশ্চিমবাংলার কথা বলার ধরন অনেকটা আয়ত্ত করে নিল। উচ্চারণ হল অনেক পরিচ্ছন্ন। এ মেয়ে যে পারবে এবং ভালভাবেই পারবে, তাতে কোনও সংশয় রইল না। বিনা দ্বিধায় নায়িকার ভূমিকাটি তাকে দিয়ে দিলাম।’
কিন্তু এবার খটকা লাগল নাম নিয়ে। রমা নামটা খারাপ নয়। কিন্তু পর্দায় দু’অক্ষরের নামটা হালকা হয়ে যাবে না তো? একটা দ্বিধা থেকেই যাচ্ছে। পরিচালক ঠিক করলেন, নাম বদল করা দরকার। নিজেও ভাবলেন। ভাবতে বললেন সহকারী নীতীশ রায়কেও। নীতীশবাবুর পরামর্শেই রমার নাম হয়ে গেল সুচিত্রা। সেই থেকে তিনি সুচিত্রা সেন। উল্টোদিকে নায়ক? না, উত্তম কুমার নয়। সুিচত্রার জীবনে প্রথম নায়ক সমর রায়।
ছবিটা তেমন চলল না। সুচিত্রার ভূমিকাও তেমনভাবে দাগ কাটল না। একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রের রিভিউয়ে সুচিত্রা সম্পর্কে লেখা হল, টেনেটুনে পাস। তবে পাশাপাশি চলছিল আরেকটা ছবির কাজ। সেই ছবিতে সুচিত্রার বিপরীতে উত্তম কুমার। ছবির নাম? সাড়ে চুয়াত্তর। ছবিটি মুক্তি পেল ১৯৫৩–র ২০ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ, সাত নম্বর কয়েদি মুক্তি পাওয়ার ঠিক তেরো দিন পর। তার পর কী হয়েছিল, সে এক ইতিহাস।
কিন্তু সেই প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’— এর কী হল? সেটিও মুক্তি পেল। তবে বাইশ বছর পর। তখন সুচিত্রার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। উত্তম–সুচিত্রা জুটি ততদিনে বাঙালির কাছে রূপকথার মতোই। সেই সময় কেউ কেউ উদ্যোগ নিলেন, সেই প্রথম ছবিটি যদি সম্পূর্ণ করা যায়! মাঝে পেরিয়ে গেছে বাইশ বছর। সেদিনের সেই কিশোরী রমা হয়ে উঠেছেন স্বপ্নসুন্দরী সুচিত্রা। ছিপছিপে সেই চেহারাও আর নেই। চারপাশের সবকিছুই তো বদলে গেছে। বদলে গেছে দর্শকদের রুচিও। এই অবস্থায় সেই ছবিকে ফিরিয়ে আনা কি ঠিক হবে? দ্বিধা ছিল সুচিত্রার মধ্যেও। ঠিক হল, ছবির চিত্রনাট্যে কিছু বদল আনতে হবে। সবার আগে ছবির নামটাই বদলে ফেলা হল। শেষ কোথায়— এর পরিবর্তে নতুন নাম হল শ্রাবণসন্ধ্যা। ছবিটি মুক্তি পেল ১৯৭৪ নাগাদ। ঠিক বাইশ বছর পরে।
সেই ছবিটি সাতদিনও চলল না। একদিক দিয়ে ভালই হল। বাইশ বছর আগের আগের রমা আর বাইশ বছর পরের সুচিত্রার মধ্যে যে অনেক ফারাক। একই ছবিতে এই দুই সুচিত্রাকে দেখতে দর্শকের হয়ত ভালও লাগত না। সুচিত্রা নিজেও বুঝতে পারেননি ছবিটার এমন করুণ পরিণতি হবে। জানলে, কখনই দ্বিতীয়বার ওই ছবি করতে রাজি হতেন না।