বড় সাংবাদিক নন, কিন্তু শুভা দত্ত তাঁর পাঠককে চিনতেন

সুব্রত সান্যাল

subha dutta

কেউ মারা গেলে তাঁর সম্পর্কে ভাল কথা বলাই রেওয়াজ। সেটাই শিষ্টাচার। সীমাবদ্ধতা কার না থাকে?‌ মৃত্যুর পর সেসব নিয়ে আলোচনা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সম্প্রতি চলে গেলেন বর্তমানের সম্পাদক শুভা দত্ত। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়নি। এমনকী ব্যক্তিগত স্তরে আলাপও ছিল না। কিন্তু পাঠক হিসেবে চেনার সুযোগ হয়েছে। সেই সুবাদেই কয়েকটি কথা।
যদি বলি, তিনি দারুণ লেখিকা বা সাংবাদিক ছিলেন, তাহলে সত্যের অপলাপ হবে। সবাই গুছিয়ে লিখতে পারেন না। কিন্তু আসল কথা হল, সেটা তিনি নিজে বোঝেন কিনা। শোনা যায়, তাঁর অধিকাংশ লেখাই নাকি অন্যরা লিখতেন। আমি অন্তত এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখি না। হাতে কাগজ পেয়েছি বলে, যা খুশি ছাপার অধিকার আছে বলে, যা খুশি লিখে গেলাম, এমনটা অন্তত করেননি। তিনি তাঁর ভাবনা মেলে ধরেছেন। অন্য কেউ হয়ত লিখেছেন। খবরের কাগজে যে বিশিষ্ট লোকেদের কলাম বেরোয়, তার অধিকাংশই এভাবে লেখা। অনেকে ভেবে বসেন, তিনি বোধ হয় দারুণ লিখছেন। তাই একের পর এক বই লিখে ফেলেন। লোকে আড়ালে হাসে, কিন্তু সামনে বলে দারুণ হয়েছে। শুভা দত্ত নিজের সীমাবদ্ধতাটুকু বুঝতেন।

সম্পাদক হিসেবে তিনি পাঠকদের পাল্‌সটা বুঝতেন। তাঁর পাঠক কারা, তাঁরা কী পড়তে চান, এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল। জোর করে আঁতেল বা বুদ্ধিজীবী সাজার চেষ্টা করেননি। খবর নির্বাচনের ক্ষেত্রে বরুণবাবু যে মানদন্ড মেনে চলতেন, শুভাদেবীও অনেকটা সেভাবেই চলার চেষ্টা করতেন। কোন কোন খবরে বৃহত্তর পাঠকের আগ্রহ আছে, বুঝতে কোনও ভুল হত না। তাই চায়ের দোকান বা সেলুনে বর্তমানে একবার চোখ বোলানোর জন্য আজও অনেকে মুখিয়ে থাকেন।
বাণিজ্যিক সাফল্যের দিকটাও ধরে রেখেছেন। বরং, আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, বরুণবাবুর মারা যাওয়ার পর বর্তমান হয়ত অতীত হয়ে যাবে। তা কিন্তু হয়নি। একদশক পরেও বর্তমান স্বমহিমায় বিরাজ করছে। আগের থেকে সার্কুলেশন অনেক বেড়েছে। যাঁরা আগে পাঠক ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই এখনও পাঠক আছেন। ছেড়ে যাননি। কারণ, পাঠককে কীভাবে ধরে রাখতে হয়, সেটা জানতেন।
হ্যাঁ, রাজনৈতিকভাবে সেই লড়াইয়ের জায়গাটা হয়ত কমে এসেছে। কী আর করা যাবে!‌ বাম সরকারের সমালোচনা করা যেত। তাতে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যেত না। কিন্তু এই সরকারটাই যে গোলমেলে। কেউ সামান্য সমালোচনা করলেই ভাতে মারার বন্দোবস্ত। এই বাস্তবটা বোঝেন বলেই অহেতুক বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু অন্যান্য কাগজ যেভাবে তাঁবেদারি করে চলে, সেটা কিন্তু বর্তমানের ক্ষেত্রে ততটা হয় না। বর্তমান তৃণমূলের পাশে দাঁড়াবে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সরকারের অনেক ভুলভ্রান্তি কিন্তু এখনও সবার আগে বর্তমানই তুলে ধরে। নবান্নের নানা গোপন খবর কিন্তু এখনও বর্তমানেই আগে উঠে আসে।
বরুণবাবু বলতেন, কনটেন্টই আসল। লেআউট খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেরিতে হলেও আনন্দবাজারের মতো কাগজও এই সারসত্যটা বুঝেছে। বরুণবাবু বলতেন, তোমার খবর যেখানেই থাকুক, পাঠক ঠিক খুঁজে নেবে। খবরটা আছে কিনা, সেটাই বড় কথা। পাঠককে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ইদানীং বিভিন্ন কাগজে লে আউটের নামে অত্যধিক বাড়াবাড়ি চোখে পড়ছে। রঙ আছে বলেই যেখানে সেখানে নানা রঙ দিয়ে, ঢাউস ছবি দিয়ে, গ্রাফিক্স দিয়ে পাতা করার একটা ঝোঁক দেখা দিয়েছে। কোন দৈনতা আড়াল করতে চায়, কে জানে!‌ যার পেটে বিদ্যে আছে, গলায় গান আছে, তাকে গয়না পরে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয় না। যার সেগুলো নেই, তাকেই গয়না পরতে হয়। কাগজের ক্ষেত্রেও তাই। যখনই কেউ লে আউটের দিকে বেশি ঝোঁকে, তখনই বুঝতে হয়, বাজারে মাল নেই। মাল থাকলে এত ভেক ধরার প্রয়োজন হত না। বড় সাংবাদিক না হয়েও এই সহজ সত্যিটা শুভা দত্ত বুঝতেন। এটাই বা কজন বোঝেন?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *