তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
বেশ অনেক দিন পর সে দিন সন্ধেয় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গিয়েছিলাম। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির সংলগ্ন স্কাইওয়াক সত্যিই মুগ্ধ করল। ওই জল-কাদা ভরা রাস্তা, চারপাশের উপচে পড়া দোকান, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঢোকার আগেই মনটাকে খারাপ করে দিত আগে। এখন স্কাইওয়াক হয়ে যাওয়ায় সত্যিই জায়গাটাকে স্বর্গ মনে হয়। এটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বটা আমাদেরও।
কিন্তু আমার বলার বিষয়টা অন্য। দক্ষিণেশ্বরে যতবারই গিয়েছি, ঠাকুর রামকৃষ্ণের ঘরে সময় কাটিয়েছি। এই ঘরে পা দিলেই একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়। আমার মতো বহু মানুষেরই হয়। ঘরে বসে দু’দণ্ড চোখ বুজে থাকায় অদ্ভুত একটা শান্তি!
সেই বিছানা, সেই খাট! মনে হয় ঠাকুর বুঝি বসে আছেন পার্ষদদের নিয়ে। মেঝেতে খাট ঘিরে মহেন্দ্রলাল দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন, স্বামী বিবেকাননন্দ! কত-কত ইতিহাস!
কিন্তু খুব খারাপ লাগে যখন দেখি, ঠাকুর রামকৃষ্ণের খাট ঘিরে একাধিক প্রণামী বাক্স বসানো। অনেকেই সেখানে টাকা ফেলছেন। এখানেই শেষ নয়। ঘরের ভিতর দরজার সামনে এক ভদ্রলোক বসে রয়েছেন টুলের উপর। চন্নমিত্ত দিচ্ছিলেন এক চামচ করে। পাশের টেবিলে আসন পাতা। সেখানে প্রচুর খুচরো পয়সা, টাকা দিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। ঠাকুরের ঘরের মধ্যেই!
দেখতে–দেখতে কিছু ঘটনা মনে পড়ছিল। এই ঠাকুর রামকৃষ্ণই বলেছিলেন না, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা!’ এই ঠাকুরকেই পরীক্ষা করার জন্য তাঁর বিছানার তলায় একটা টাকা রেখে দিয়েছিলেন স্বামীজি। ঠাকুর বিছানায় বসেই লাফিয়ে উঠে বলেছিলেন, ‘জ্বলে যাচ্ছে! শরীর জ্বলে যাচ্ছে!’ টাকাকে এতটাই ঘৃণা করতেন। এ সবই তো ইতিহাস!
আরও ঘটনা। রাণী রাসমণির জামাই মথুরমোহন একবার ঠাকুর রামকৃষ্ণকে কিছু জমি-জমা লিখে দিতে গিয়েছিলেন। দলিল নিয়ে এসে সে কথা বলতেই ঠাকুর নাকি, ‘আমাকে সংসারে বাঁধতে চাস…আমাকে সংসারে বাঁধতে চাস…’ বলে বাঁশ নিয়ে তাড়া করেছিলেন মথুরমোহনকে!
পাশেই তো সেই নাট মন্দির। যেখানে স্বয়ং রাণী রাসমণীকে ভাবের ঘোরে থাপ্পড় মেরে দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। বলেছিলেন, ‘মায়ের মন্দিরে এসেও বিষয় চিন্তা!’ রাণী পরে বলেছিলেন, সত্যিই সেই সময় একটা বৈষয়িক মামলা, টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করছিলেন তিনি। ছোট ভট্টাচার্যের চড় তাঁর চেতনা ফিরিয়েছে।
রামকৃষ্ণ যদি চাইতেন, সামান্য তম ইচ্ছেও প্রকাশ করতেন, সেই যুগে তাঁকে সোনায় মুড়ে দেওয়ার জন্য প্রচুর মানুষ এগিয়ে আসতেন। এসেও ছিলেন। সেই ‘লোভ’-টাকে বর্জন করতে পেরেছেন বলেই আজ তিনি ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
সেই তাঁর ঘরেই কিনা, এত টাকা-পয়সার গন্ধ? খাট ঘিরে ওই দান বাক্সগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল, ঠাকুর যেন কয়েদখানায় বন্দী! যেন বিছানায় বসে চিৎকার করে বলছেন, ‘ওরে, ও গুলো সরা! আমার শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে!’
দক্ষিণেশ্বরে মন্দিরে চারিদিকেই দানপাত্র রাখা রয়েছে। মা ভবতারীণীর মূর্তির দরজায় তো বটেই, বারো মন্দিরের শিবের সামনেও। সে নিয়ে আপত্তি নেই। মন্দিরে লোকে দান করবেন, এটাই স্বাভাবিক। ইচ্ছে হলে, পাশের অফিসে গিয়েও দান করে আসা যায়। কিন্তু এই টাকা-পয়সার ঘেরাটোপ থেকে ওই একটা ঘরকে কে কি মুক্তি দেওয়া যেত না ? কতৃপক্ষ একবার ভেবে দেখতে পারেন।