ঢাকা থেকে কলকাতায় হাজির এক যুবক। জাতিতে মুসলিম। মোহনবাগানের নামও কখনও শোনেনি। হঠাৎ সেও জড়িয়ে গেল শিল্ড জয়ের সেলিব্রেশনে। কীভাবে? টাইম মেশিনে ১৯১১ তে ফিরে গিয়ে তাঁর বয়ানেই সেই লেখা তুলে আনলেন —
ময়ূখ নস্কর
আপনারা আমারে চিনবেন না। আমার নাম রহমান। দ্যাশ ঢাকায়। কইলকাতায় আইছি চাচার বাসায়। আপনাগো ধর্মতলায় আমার চাচার একখান দোকান আছে। কিন্তু এর আগে আমি কখনও এই শহরে আসি নাই। আব্বাজান কইল, ইংরেজ জমানায় চাকরিবাকরি সবই তো হিন্দুদের। মুসলমানদের বিজনেছ করতে হইব। তাই চাচার কাছে আইছি বিজনেছ শিখতে।
আমাগো ঢাকায় এখন অনেকেই মুসলিম লিগ করছে। লিগের নেতারা কয়, ইংরেজ বাঙলা ভাগ করলে মুসলমানদের ভালো হইব। পূর্ববাংলায় মুসলমানরা বেশি, চাকরিবাকরি আমরাই বেশি পাব। কিন্তু কইলকাতায় আইসা দেখি আমার চাচা মানুষটা অন্য কিসিমের। সে কয়, “ইংরাজরা পয়লা নাম্বারের হারামি। ওরা হিন্দুদের ভালো চায় না মুসলমানদেরও না।“ আমার মন মানতে চায় না।
এখানে একজন লোকের সঙ্গে আলাপ হইছে। বিকালে ধর্মতলার মসজিদে তার সঙ্গে দেখা হয়। চাচার কথার থিকা তার কথা আমার বেশি ভালো লাগে। সেদিন বিকালে লোকটা কইল, “আজ মোহনবাগানের খেলা আছে। ইংরেজদের সঙ্গে।“
মোহনবাগানটা আবার কী জিনিস? লোকটা বলে, “কইলকাতার ক্লাব। হিন্দুদের ক্লাব। ইনসাল্লা। মোহনবাগান যেন হারে।”“ইনসাল্লা। যেন হারে। আমি ঢাকার পোলা। কইলকাতার ক্লাবকে আমি সাপোর্ট করুম না।“
এমন সময় বাইরে প্রচণ্ড গোলমালের আওয়াজ শুনা গেল। কারা যেন খুব চেঁচাইছে। হঠাৎ শুনি আমার চাচার চিৎকার, “রহমান বাইরে আইস, শিগগির বাইরে আইস।” ছুটে বাইরে গিয়ে দেখি, একদল লোক, দেখে বুঝলাম তারা হিন্দু, কারণ ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন বামুন আছে, ধর্মতলার দিকে এগিয়ে আসছে। চাচা কইল, “শুনছস
রহমান, শুয়ারের বাচ্চাগুলো হাইরা গেছে। মোহনবাগান জিতছে রে মোহনবাগান জিতছে। ” বলে পাগলের মতো ছুইটা গেল ভিড়ের দিকে। চাচার পিছু পিছু আরও একদল লোক। সর্বনাশ দাঙ্গা না লাগে।
দুটো দল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হিন্দুদের দলটা চিৎকার করে বলল, বন্দেমাতরম। মুসলমানদের দলটা পাল্টা চিৎকার করে বলল, আল্লা হু আকবর। কিছুক্ষন সব চুপচাপ। তারপর হঠাৎ দুই দল একসঙ্গে চিৎকার করে বলল, মোহনবাগান কি জয়। তারপর যে যাকে পারল জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি শুরু করে দিল।
ওই দ্যাখ আমার চাচা আনন্দে লাফাচ্ছে, আশপাশের দোকান থিকা মুসলমানরা বাইরে আসছে, কেউ হাসছে, কেউ আনন্দে কাঁদছে, কেউ আবার রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। কারা যেন ব্যান্ডপার্টি ভাড়া করে আনছে। মুসলমানদের ব্যান্ড। তারা গলার শিরা ফুলাইয়া সানাই বাজাইছে, হাতুড়ি পিটানোর মতো জোরে জোরে ড্রাম পিটাইছে। সেই বাজনার থিকাও জোরে আওয়াজ হইছে “মোহনবাগান কি জয়।” শুইনা শুইনা আমারও কেমন রক্ত গরম হইয়া গেল, চেঁচাইতে লাগলাম, “মোহনবাগান কি জয়।” “মোহনবাগান কি জয়।”
এই মোহনবাগান কী জিনিস বলেন তো, যার কাছে হিন্দু মুসলমান এক হইয়া যায়? যে লোকটা বলছিল, মোহনবাগান হিন্দুদের ক্লাব, সে কোথায় গেল বলেন তো? সেই ভয় দেখানো লোকটা গেল কোনখানে?
(মোহনবাগান দিবস নিয়ে আরও অনেক লেখা থাকবে বেঙ্গল টাইমসের পাতায়। নানা আঙ্গিক থেকে ফিরে দেখা হবে সেই ঐতিহাসিক শিল্ড জয়কে। আগামীকালের বিষয়? বলেই ফেলা যাক। শিবদাস ভাদুড়ির গোপন ডায়েরি। শিল্ড জয়ের রাতে ঠিক কী লিখেছিলেন শিবদাস ? সেই কথাই উঠে এল ময়ূখ নস্করের লেখায়। অপেক্ষা করুন।)