বড় দল আর ছোট দলের তফাতটা ক্রমশ কমে আসছে। ছোট দল বলে কাউকেই আর হেলাফেলা করা যাবে না। তারাও চমকে দিতেই পারে। আর কাউকেই আগাম ফেবারিট বলা যাবে না। এবারের বিশ্বকাপ যেন সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল। লিখেছেন সুগত রায়মজুমদার।।
রাশিয়ায় আয়োজিত ২০১৮–র বিশ্বকাপ ফুটবলে কোনও বড় ফুটবল–বিশেষজ্ঞই তাঁদের ফেবারিট দেশ মেলাতে পারেননি। সেটা আমি প্রতিনিয়ত বিশ্ব ফুটবল–দর্শনে নিয়মিত যুক্ত থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলাম, ৪ জুন এই কাগজেই প্রকাশিত হয়েছিল, ‘এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল অঘটনের বিশ্বকাপ ফুটবল হতে চলেছে’ এই হেডিং দিয়েই।
সাধারণত টিভিতে প্রতিদিন গভীর রাতে ইউরোপের ইপিএল, স্প্যানিশ লা লিগা, ইতালির সিরি আ, জার্মান লিগ, ফ্রেঞ্চ লিগ দেখে থাকি। নানা দেশের এই লিগ দেখেই মনে হয়েছিল, এই বিশ্বকাপ ফুটবল খুবই কঠিন, আকর্ষণীয় এবং অঘটনের বিশ্বকাপ হতে চলেছে। ছোট দেশগুলি বিশেষজ্ঞদের মুগ্ধ করেছে এই বিশ্কাপে। এটাই এবারের বিশ্বকাপের বড় এক প্রাপ্তি।
ইউরোপের নানান দেশের লিগগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা অংশ নেন। সেখানে যেমন ইউরোপের, তেমনি আফ্রিকার বহু দেশের, লাতিন আমেরিকার বহু দেশের খেলোয়াড়রা, এমনকি এশিয়ার জাপান, কোরিয়ারও কিছু খেলোয়াড় এই নামকরা ক্লাবগুলিতে রীতিমতো নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দেন। সেটা দেখেই মনে হয়েছিল, এটা অঘটনের বিশ্বকাপ হতে চলেছে। বেশ কিছু দেশের খেলোয়াড়রা গোকূলে বেড়েই চলেছেন ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে, সেটা কেউ টের পাননি। এই লেখাটি লিখেছিলাম ২৯ জুন ২০১৮, বেঙ্গল টাইমস সংবাদপত্রে।
ইংল্যান্ডকে বহুদিন পর দেখলাম প্রচার–বিমুখ দল গড়ে কোচ সাউথগেটকে প্রাক্তন খেলোয়াড় লিনেকার, শিয়েরারদের মতো বিশেষজ্ঞদের কাছে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। সাউথগেট নামের দিকে ছোটেননি। তিনি দক্ষতা ও তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম দাবিদার করতে পেরেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত পারেনি অত্যধিক সহজ সুযোগ নষ্ট করায়। সেমিফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিদায় নেয়। এবারের বিশ্বকাপে কেউ কি ভেবেছিলেন, জার্মানের মতো ফুটবলে উন্নত দেশকে কোরিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিতে হবে! এটাকেই বলে অঘটন। আফ্রিকার মরক্কো, টিউনেশিয়া, নাইজেরিয়া রীতিমতো টক্কর দিয়েছে নামী দেশগুলির সঙ্গে। কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন, রাশিয়ার মতো বিশ্বের ৭০ নম্বর র্যাঙ্কিংয়ের দেশ বিশ্বের ২ নম্বর র্যাঙ্কিংয়ের দেশ স্পেনকে হারিয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেবে? র্যাঙ্কিংটা এরপর শুধু সংখ্যা হিসেবেই গণ্য হবে পরবর্তী বিশ্বকাপে। সেজন্য বিশ্বের ফুটবল জগৎকে সজাগ হতেই হবে। এ ছাড়াও ইউরোপের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর দেশগুলি বলতে সুইডেন, সুইজারল্যান্ডও চমকে দিয়েছে সকলকে। এই দেশগুলি ব্রাজিল, জার্মান, স্পেনের মতো দেশকেও রেয়াত করেনি। ছোট দেশগুলি আমাদের সকলকে চমকে দিয়েছে। ফ্রান্সের কাছে আর্জেন্টিনার মর্মান্তিক হারে বিদায় খুবই বেদনাদায়ক। তবে এটাও ঠিক, মেসি এখন একা কিছুটা সামাল দিতে পারবেন। পুরো প্রতিযোগিতা টানতে পারবেন না। এ ছাড়াও বিশ্বকাপের মতো আসরে তৃতীয় শ্রেণীর গোলকিপার ও তৃতীয় শ্রেণীর বয়স্ক খেলোয়াড় দিয়ে এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না। যেখানে ছোট দলগুলি ৯০ ও ১২০ মিনিট এক দমে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ক্রোয়েশিয়াকে তো ৩টি ১২০ মিনিটের ম্যাচ খেলতে হল। তা–ও তারা হার মানেননি ইংল্যান্ডের কাছে পিছিয়ে থেকেও। ক্রোয়েশিয়া এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবলটাই খেলেছে। তাদের সৃষ্টিশীলতাই ইংল্যান্ডকে নাজেহাল করে দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই। ফলও পেয়েছে হাতেনাতে। ফাইনালে উঠে বিশ্বকাপের দাবিদার হয়ে। কোনও বিশেষজ্ঞই কল্পনাও করতে পারেননি, বেলজিয়ামের কাছে ব্রাজিলের নাস্তানাবুদ হওয়া। গতি ও স্কিলই ছিল বেলজিয়ামের সম্পদ। এশিয়ার জাপানের লড়াই অনেক দিন মনে থাকবে বেলজিয়ামের মতো ৩ নং র্যাঙ্কিং দলে বিরুদ্ধে খেলায়।অনুমান সাপেক্ষে ব্রাজিলই ছিল সবচেয়ে ফেবারিট এবারের বিশ্বকাপে। কারণও ছিল। তাদের কোচ দলটির অনেক পরিবর্তন করে বাছাইপর্বে সকলের আগে বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পায়। তা সত্ত্বেও বেলজিয়ামের কাছে অনেকটাই নাকানিচোবানি খেয়ে বিদায় নেয় বিশ্বকাপ থেকে।
বিশ্বের ১৮ নং র্যাঙ্কিংয়ের দেশ ক্রোয়েশিয়া এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় চমক দিয়েছে। এটা কোনও ফ্লুকে নয়। ক্রিকেটে অনেক সময় ফ্লুকে অনেক বড় দেশ কোনও ছোট দেশের কাছে হারে। তার প্রমাণ আছে ভুরিভুরি। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলে এরকম নজির খুবই কম। অতীতে দেখা গেছে ইউসোবিওর পর্তুগাল কোরিয়ার কাছে ১৯৬৬–র বিশ্বকাপে ২ গোলে পিছিয়ে থেকেও ৫–২ গোলে জিতে খেলাটি বের করে নেয়। অতীতে বড় দলের এরকম নজির খুব একটা দেখা যায়নি বিশ্ব ফুটবলে।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলকে পুরোটাই অঘটনের বিশ্বকাপ বলতে দ্বিধা হচ্ছে না। এই ছোট দেশগুলির খেলোয়াড়রা কখন গোকূলে বেড়ে উঠেছেন, তা টের পেতে দেয়নি ছোট দেশগুলি। তারা প্রচারের আলোয় আসতে দেয়নি এই খেলোয়াড়দের। কোরিয়ার গোলকিপারের ‘হার না মানা’ মনোভাবের জন্যই জার্মানির বিদায়। ছোট দেশগুলির খেলোয়াড়দের কিছু হারানোর ছিল না। জয করার জন। পড়েছিল ফুটবল–বিশ্ব। এই খেলোয়াড়রা দেশের হয়ে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, ‘আমরাও তো ইউরোপের নামী দল বার্সিলোনা, রিয়েল মাদ্রিদ, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাসের মতো দলগুলিতে খেলি। সুতরাং ওরাই কি (ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার দেশগুলিই) শুধু চ্যাম্পিয়ন হবে? আমরাও চেষ্টা করে দেখি না।’ সেই চেষ্টারই ফল ক্রোয়েশিয়া ও ফ্রান্সের মতো দেশের আন্তরিক প্রচেষ্টা। এই ক্রোয়েশিয়া ১৯৯০ সালে যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ক্রোয়েশিয়ার লড়াই দেখে সকলে মুগ্ধ। যে দেশ ১৯৯০ সালে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেল, সেই দেশই ২০১৮–র বিশ্বকাপে ৩টি ১২০ মিনিটের ম্যাচে লড়াই করে ফাইনালে পৌঁছে গেল। এটা কম গৌরবের নয়। এত ক্লান্তির মধ্যেও তারা ফাইনালে ফ্রান্সের মতো প্রতিষ্ঠিত দলের বিরুদ্ধে দারুণভাবে প্রথমার্থ শুরু করে। প্রথমে নিজেদের ত্রুটিতে মান্ডুভিচের মাথায় লেগে গোলে ঢুকে পিছিয়ে পড়ে। লড়াই কিন্তু তারা ছেড়ে দেয়নি। কিছুক্ষণ পরেই পেত্রিভিচ গোল শোধ করে ক্রোয়েশিয়া মাঝমাঠ নিজেদের দখলে নেয়। তখনও কেউ ভাবেননি, ক্রোয়েশিয়া হারতে পারে। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে কিছুটা ভাগ্যেরও প্রয়োজন হয়। ২০১৪–র বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসির মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ও যে গোল মিস করেছিলেন, তার জন্যই আর্জেন্টিনাকে রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সেই সুযোগটাই জার্মানি নিয়ে গোৎজের গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ভাগ্য ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে না থাকায় ডিফেন্সে সেই গোলদাতা পেত্রিভিচের হাতে হঠাৎ বলটি লেগে ফ্রান্স পেনাল্টি পেয়ে এগিয়ে গিয়ে ক্রোয়েশিয়াকে হতাশ করে দেয়। দুটি গোলই নিজেদের দোষে খেয়ে তারা বুঝতে পারে, দিনটি তাঁদের জন্য নয়। তার পর থেকেই ফ্রান্স সেই সুযোগটা নিয়ে হতাশ ক্রোয়েশিয়াকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। যদিও যে বলটি পেত্রিভিচের হাতে লেগেছিল, একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যেত, বলটা পেত্রিভিচ ইচ্ছাকৃত হাতে লাগাননি। বলটি মাতুইদির গায়ে লেগেই তাঁর হাতে লেগেছিল। ফাইনালে রেফারির একটু সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত ছিল। বা, আরও একবার রিভিউটা দেখে বিচার করা উচিত ছিল। সব খেলাতেই ছোট দেশগুলি এই ভুলের শিকার হয়। তবে ক্রোয়েশিয়ার এই লড়াইকে মর্যাদা দিতেই হবে। তাদের এই হার কোনও মতেই অগৌরবের নয়। বরং তাদের পরবর্তীকালে আরও সজাগ করে তুলবে। ক্রোয়েশিয়ার একটা লাভ হয়েছে। পরবতী বিশ্বকাপগুলিতে তারা অন্যতম ফেবারিটদের তালিকায় থাকবে বিশেষজ্ঞদের কাছে। ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের জানাই সেলাম।
সেজন্যই এবারের বিশ্বকাপকে অভূতপূর্ব বলাই যায়। ছোট দেশগুলির খেলোয়াড়রা প্রমাণ করে দিলেন, চেষ্টা করলে আমরাও পারি বিশ্বকাপ জয় করতে। সুতরাং ভবিষ্যৎ আগাম জানান দিল, কোনও দেশকেই আগামীদিনে নিশ্চিত ফেবারিট বলা যাবে না। সেটাই প্রমাণিত এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে।