সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
কর্নাটকের নির্বাচনকেকে ঘিরে সাধারণ মানুষের যে বেশ আগ্রহ এবং উৎসাহ ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একদিকে এই নির্বাচন ছিল কর্ণাটকের ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের কাছে নিজেদের শক্তি বিচার করার অগ্নিপরীক্ষা। কারণ একের পর এক ক্ষমতাসীন রাজ়্যের নির্বাচনে তারা বিজেপির কাছে পরাস্ত হচ্ছিল। কয়েকটি রাজ্যে বিজেপির থেকে এগিয়ে থেকেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ায় সরকার গড়তে পারেনি। যেমন মণিপুর বা গোয়া বা মেঘালয়। বিজেপির কাছেও এই নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একদিকে যেমন কর্ণাটক ছিনিয়ে নেওয়া, তেমনি দক্ষিণ ভারতে নিজেদের প্রভুত্ব বিস্তার করা। কারণ, এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের কোনও রাজ্যেই তারা ক্ষমতাসীন নয়।
নির্বাচনের ফলাফল বিজেপির অনুকূলে গেলেও এককভাবে সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় আসন পায়নি। তাই অনেকের ধারণা ছিল, বিজেপি হয়তো কংগ্রেস বা অন্যান্য দলের জয়ী বিধায়কদের মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে বা অন্যান্য কোনও অসদুপায়ে নিজেদের দলে টেনে ফেলবে। যেমনটা তারা ঘটিয়েছিল মণিপুর বা গোয়ায়। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, বিজেপি নাকি কংগ্রেস এবং জেডিএসের বিধায়কদের ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত টোপ দিয়েছিল। এরই মধ্যে কর্ণাটকের রাজ্যপাল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী বিজেপিকে সরকার গঠনের অনুমতি দিলেন। ইয়েদুরাপ্পা শপথ নিয়ে ফেলায় অনেকেরই ধারণা হয়েছিল কর্ণাটকের বিজেপির সরকার গঠন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কারণ বিজেপি্র রাজকোষে এখন হাজার হাজার কোটি টাকা। দেশের প্রায় সব শিল্পপতি ট্যাক্সে বিশেষ ছাড়ের মত প্রত্যক্ষ বা অন্যান্য পরোক্ষ সুবিধা পেয়ে এখন বিজেপির গুণগ্রাহী। সঙ্গে আছে অমিত শাহ–র মতো ধুরন্ধর এবং বিধায়ক কেনাবেচায় পারদর্শী ব্যক্তি। অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর মতো তরুণ নেতা তথা কংগ্রেসের সভাপতি কি পারবেন বিজেপির এই চক্রান্তের ও কপটতার জাল বিচ্ছিন্ন করে তাদের সরকারে আসার পথ বন্ধ করতে ?
বাস্তবে কিন্তু চিত্রটা দেখা গেল অন্যরকম। আর এখানেই রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেসের বিচক্ষণতা। রাহুল গান্ধী বুঝিয়ে দিলেন, তিনি আর হেলাফেলা করার মতো ব্যক্তি নন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতাও চোখে পড়ার মত। বস্তুতঃ মণিপুর বা গোয়ায় নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে যে রাহুল গান্ধী কার্যতঃ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ছিলেনই না বা পরে অবতীর্ণ হয়েও অসহায় ভাবে “চিরশত্রু” বিজেপিকে অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে দেখেছিলেন, তিনি যে সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, তা ভালোমতই বোঝা যাচ্ছে। তাঁর প্রথম বিচক্ষণতা সুপ্রিম কোর্টে তড়িঘড়ি মামলা রুজু করা। অসাধারণ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ত, বিধায়কদেরকে বিজেপি গোপনে মোটা টাকার টোপ দিচ্ছে, এটা জেনে তাদের গোপনে হায়দ্রাবাদের একটি হোটেলে গৃহবন্দী করে রাখাটাও একটা দারুণ সিদ্ধান্ত। তবে রাহুল গান্ধীর “মাস্টারস্ট্রোক” অবশ্যই জেডিএসকে মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে দিতে রাজি হওয়া। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন, তিনি যদি জেডিএস কে মুখ্যমন্ত্রী পদ না ছেড়ে দিতেন তাহলে বিজেপি সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে জেডিএসের সঙ্গে ঠিক জোট বেঁধে নিত। এ ক্ষেত্রে জেডিএস–কে মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে দেওয়ার অর্থ তাদের এই বার্তা দেওয়া যে, বিজেপির সঙ্গে জেডিএসের জোট হলে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীকেই মেনে নিতে হত।
সর্বোপরি কর্নাটকের ভোটের আগে রাহুল গান্ধী যে বৈঠক করেছিলেন জেডিএসের নেতা কুমারস্বামীর সঙ্গে, তা যে নিছক সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ ছিল না, সেটা আজ প্রমাণিত। বরং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সেখানে ফলাফলের নিরিখে নির্বাচন পরবর্তী জোটের সম্ভাবনার পথ খোলা রাখার আলোচনাই হয়েছিল। আর বিচক্ষণ রাহুল এটাও ভালোভাবেই বুঝেছিলেন, যে নির্বাচনের আগে জেডিএসের সঙ্গে জোট বাঁধলে বিজেপি এই প্রচার এটাই করবে যে বিগত পাঁচ বছরে কর্নাটকে যাবতীয় দুর্নীতি ঢাকতেই কংগ্রেস জেডিএস–কে নিজেদের দোসর বানিয়েছে। তাতে হয়তো সেই প্রচার বিজেপির অনুকূলে যেতে পারত। সেক্ষেত্রে বিজেপি হয়ত এককভাবে সরকার গঠনের সংখ্যা পেয়ে যেত। তাই এই নির্বাচনের ফলপ্রকাশের ঠিক পরেই জোটের সিদ্ধান্ত এবং দুই দলের বিধায়কদের কালো টাকার হাত থেকে সুরক্ষিত রেখে বিজেপির পাতা ফাঁদে পা না দেওয়ার ব্যবস্থা করাটা এককথায় অনবদ্য। এইভাবেই রাহুল গান্ধী বুঝিয়ে দিলেন, তিনি আর হেলাফেলা করার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। বরং ২০১৯ সালে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে আগ্রাসী বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তিনিই কংগ্রেসের প্রধান মুখ এবং আগের ভুল-ভ্রান্তি থেকে সমুচিত শিক্ষা নিয়ে তিনি এখন যথেষ্টই বিচক্ষণ এবং অনেক বেশি পরিণত। আগামী দিনের নির্বাচনে বিজেপির প্রথমসারির নেতাদের চোখে তিনি অবশ্যই সমীহ করার মতো।