রবি কর
সারা দেশজুড়ে অসহিষ্ণুতা নিয়ে জোর চ্যাঁচামেচি শুরু হয়েছে। কেউ বলছে, বিজেপি অসহিষ্ণু। কেউ বলছে, কংগ্রেসও কম যায় না। কেউ বলছে, দেশ ছেড়ে চলে যাব। কেউ বলছে, গেলে বাঁচা যায়। তখন আগেরজন বলছে, যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব ?
সবাই সবার নিন্দা করছে। কিন্তু ভাল-টা কেউ বলছে না। দেশজোড়া অসহিষ্ণুতার মধ্যে সহিষ্ণুতার উদাহরণ কেউ দেখাতে পারছে না। এতবড় দেশ, তার মধ্যে কি কেউ নেই, যাঁকে দেখে আমরা সহিষ্ণুতা শিখতে পারি।
নিশ্চয় আছে। ভগবান যুগে যুগে দূত পাঠান। মানুষ তাঁদের চিনতে পারে না। কলি-যুগে তো অবস্থা আরও খারাপ। মানুষের চোখে সানগ্লাস, কানে হেডফোন। দূতকে দেখবে কী করে, দূতের কথা শুনবে কী করে ?
কিন্তু আমি, রবি কর, তাঁকে চিনতে ভুল করিনি। করবও না। ব্যর্থ নমস্কারে তাঁকে ফেরাব না। তাঁকে আমি জীবনের ধ্রুবতারা করবই। হে দেবী, দে দিদি, আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। আমাকে আশীর্বাদ করুন।
এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, আমি কার কথা বলছি। আমি বোকা-হাবা লোক হলেও আপনারা তা নন। তবে আপনারাও অসহিষ্ণু। এইটুকু পড়েই এতক্ষণ হয়ত আমাকে গালমন্দ করছেন। ভাবছেন, আমি বঙ্গভূষণ বা টিকিট পাওয়ার জন্য তাঁবেদারি করছি। ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। যিনি মহান, তাঁকে মহান বলতে চাই। কিছু উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা আপনাদের বুঝিয়ে দিই। আশা করি, আপনারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন।
দেশজুড়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের শুধু গালমন্দই করেন। কিন্তু বামফ্রন্টের বিধায়কদের সঙ্গে দিদির সম্পর্কটা কেমন, দেখুন। গত বিধানসভা ভোটে এরা সবাই ছিল হার্মাদ, মা মাটি মানুষের শত্রু। সাড়ে চার বছর ধরে এরা মা মাটি মানুষের পেছনে কাঠি করেছে। কি্ন্তু বিধানসভা ভোটের মাস ছয়েক আগে হঠাৎ করে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হচ্ছে।
নিন্দুকেরা বলে, এরা বুঝেছে, পরেরবার নিজের আসনে জয়ী হবার নো চান্স। অনেক আগেই দলবদল করা যেত। কিন্তু দলত্যাগ বিরোধী আইনে ফেসে গেলে উপনির্বাচনের হ্যাপা পোয়াতে হবে। তার থেকে এমন একটা সময়ে উ্ন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হচ্ছেন, যখন নো উপনির্বাচন, ডাইরেক্ট বিধানসভা ভোট। আর অন্য দল থেকে এলে দিদির দলে টিকিট পাকা।
এখানেই দিদির সহিষ্ণুতা। সারা বছর যারা মুখে রক্ত তুলে পার্টি করে, তাদের থেকেও দিদি অন্য দল থেকে আসা লোকদের বেশি ভালবাসেন। উদয়ন গুহ-র কথাই ভাবুন। পুরসভা ভোটে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে একাই জল ঢেলে দিয়েছিল। অশোক ঘোষ দিদিকে ‘ছোট বোন’ বলেছিলেন বলে উদয়নের সে কী রাগ! সেই রাগে দলই ছেড়ে দিলেন। কী আশ্চর্য! দিদি তাঁকেই সাদরে ঠাঁই দিলেন। দলে আসামাত্র ডাইরেক্ট দলের সাধারণ সম্পাদক।
তারপর ধরুন তাপস চট্টোপাধ্যায়। এতকাল ছিল হার্মাদ। পুর ভোটের আগেই হয়ে গেল ‘her mad” মানে ম্যাড ফর হার। অমনি সাতখুন মাপ। হয়ে গেলে ডেপুটি মেয়র। শুধু সহিষ্ণুতা নয়, মহানুভবতা। মেয়রের কথাই ধরুন। সবাই বলত, মুকুলের লোক। সটান টেনে এনে মেয়র, কজন পারবেন এই উদারতা দেখাতে ?
এরপর ধরুন ঋকবেদ রায়। পাঠভাঙা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, মিষ্টি মিষ্টি হেসে, টিভিতে দিদির নামে কত কথাই না বলেছে। অন্য কেউ হলে ওকে আদিগঙ্গায় চুবিয়ে মারত। হাত থেকে ঋকবেদ কেড়ে নিয়ে অথর্ব করে দিত। কিন্তু শরণাগতকে দিদি কখনও ফেরান না।
বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও দিদি সহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন। দিল্লিতে দেখুন, অনুপম খের আমিরকে গালাগাল দেয়। লেখকরা সাহিত্য অ্যাকাডেমি ফিরিয়ে দেন। বুদ্ধিজীবীরা অ্যাওয়ার্ড ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এখানে সে সমস্ত কিছুই হয় না। ওই যে ‘নরখাদক’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ওর তিনটে চ্যালাচামুন্ডা ছিল। অবোধ সরকার, আলুরদম শীল, ছিদ্রনীল সেন। দিদি কি ওদের স্বরূপ জানে না? ভালই জানে। কিন্তু দিদি আরও জানে, বুদ্ধিজীবীরা শাসককে বাপ-মা বলে মনে করে। শাসক পাল্টে গেলে তাদের আক্ষরিক অর্থেই বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো দশা হয়। তখন তারা অনাথের মতো নতুন শাসকের দ্বারস্থ হয়। অন্য শাসক হলে তাদের দূর দূর করে তাড়া করত। কিন্তু দিদির মনে অসহিষ্ণুতার কোনও জায়গা নেই। মাদার টেরিজা মারা যাওয়ার পর একমাত্র তিনিই আছেন, যিনি অনাথদের আশ্রয় দেন। শোনা যাচ্ছে, আগামীদিনে সব্যসাচী চক্রবর্তীকেও নাকি আশ্রয় দিতে পারেন। দেবেনই তো, নিশ্চয় দেবেন। গ্যারান্টি দিতে পারি, বুদ্ধবাবু যদি একবার মুখ ফুটে বলেন, তাঁকেও দিদি আশ্রয় দেবেন।
আমার মনে হয়, দিদি বাইরে কালীভক্ত হলেও ভেতরে ভেতরে বৈষ্ণব। তাই কলসীর কানা মারলেও তিনি প্রেম দেওয়া বন্ধ করেন না। থানায় ঢুকে পুলিশকে মারুক, কলেজে ঢুকে অধ্যক্ষকে মারুক, যাই করুক, দিদি তাকে প্রেম দেবেনই। সেই যে একজন বলেছিল, ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব।’ দিদি বলেছিল, ‘আমি কি ওকে মারব ? আই কিল হিম ?’ না, দিদি কাউকেই কিল করবেন না। শর্ত একটাই, উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হতে হবে।
গতবার সিদ্দিকুল্লার সভায় পুলিশকে ধুমাধুম পেটানো হল। সবাই কত নিন্দে করল। কিন্তু সিদ্দিকুল্লা উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হলেন। তখন দিদি সিদ্দিকুল্লার দলকে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তুলনা করে বসলেন। অর্থাৎ, সিদ্দিকুল্লা আর বিবেকানন্দ দিদির কাছে এক। একজন শাসকের কাছে সবাই সমান হয়। একেই বলে সহিষ্ণুতা। এরপর দিদি ফুরফুরায় যাবেন, ফুরফুরে মেজাজেই যাবেন। ত্বহা সিদ্দিকি এতদিন যত গালমন্দই করুন, দিদি কিছুই মনে রাখেননি। ফুরফুরা শরিফকে সবরমতী আশ্রমের সঙ্গে তুলনা করে বসতেই পারেন।
যদি মুখ্যমন্ত্রী না হয়ে দিদি আমাদের প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে দেখতে সহিষ্ণুতা কেমন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। পাকিস্তান, চীন সবাই দলে দলে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হত। বলা যায় না, আই এস আই প্রধান পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হতেন (একুশে জুলাইয়ের সময় যিনি স্বরাষ্ট্র সচিব ছিলেন, তিনি যদি দিদির মন্ত্রী হতে পারেন, তাহলে আই এস আই প্রধান ভারতের মন্ত্রী হবেন না কেন? )। আই এস আই নাকি ভারতে জাল টাকা পাচার করে। ডেলো পাহাড়ে আই এস আইয়ের সঙ্গে একটা বৈঠক করলেই ওরা সততার পথে চলে আসত।
আর দিদি যদি রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব হতেন, তাহলে আলকায়দা, আইএস নিমেশে ঠান্ডা হয়ে যেত। জাগরি বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতোকে যেমন সহিষ্ণুতা দেখানো হয়েছে, জঙ্গিদের সঙ্গে তেমনটাই দেখানো হত। আফগানিস্তানে একটা আলুর চপের কারখানা, সিরিয়াতে একটা মোমের মিউজিয়াম, ইরাকে মাটি উৎসব। আয়োজন করলেই প্রচুর কর্ম সংস্থান। জঙ্গিরা দলে দলে সিন্ডিকেটের ব্যাবসা খুলে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হত। জঙ্গিরা নাকি প্যারিসের আইফেল টাওয়ার উড়িয়ে দেবে। দিক। দিদি আগেই জানতেন, জঙ্গিরা একদিন এই হুমকি দিতে পারে। তাই, নিউটাউনের ইকো পার্কে দিদি আগাম আইফেল টাওয়ার বানিয়ে দিয়েছেন।
তবে হ্যাঁ, ওই এলাকায় অধীর চৌধুরী বা রুপা গাঙ্গুলি সভা করতে গেলে কী হবে, বলা যায় না। তখন ছোট ছোট ছেলেরা দুষ্টুমি শুরু করে দিতে পারে। দিদিও সহিষ্ণুতা না দেখিয়ে রাফ অ্যান্ড টাফ হয়ে উঠতে পারেন। তাই যা করবেন, ভেবেচিন্তে করবেন। দিদির সহিষ্ণু রূপ দেখতে হলে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হবেন।