ভাষা শিখুন, একটু অন্যভাবে

অরিজিৎ চৌধুরি

নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। শতাব্দী বদলে গেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বদলে গেছে। মানুষের দৈনন্দিন অভ্যেস, রুচিবোধ, মূল্যবোধ সবকিছুই বদলে গেছে। ভাষা নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা বিভ্রাট।
সত্যিই কি একজন মানুষ মাতৃভাষা আঁকড়েই থাকবে?‌ নাকি বিশ্বায়নের সুরে সুর মিলিয়ে অন্য ভাষায় পারদর্শী হবে?‌ দুটো একসঙ্গে চালিয়ে যাবে?‌ নাকি মাতৃভাষাকে বিসর্জন দেবে?‌ সারা পৃথিবীতেই চলমান এই বিতর্ক। আমাদের মতো বহু সংস্কৃতির, বহু ভাষাভাষীর দেশে এই প্রশ্নটা আরও বেশি করে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা সবাই ভারতবাসী। কিন্তু এটাই কি আমাদের একমাত্র পরিচয়?‌ আরও অনেক সত্তা ভিড় করে আমাদের পরিচিতির মধ্যে। আমরা কেউ মারাঠি, কেউ তামিল, কেউ তেলেগু, কেউ কন্নড়, কেউ বাঙালি। নানা প্রদেশে নানা ভাষা ছড়িয়ে আছে। এক রাজ্যেই ছড়িয়ে আছে কত উপভাষা। সবাই সেসব ভাষা শিখেই বড় হই। সেই ভাষাতেই বাড়িতে কথা বলি। সেই ভাষাতেই লেখাপড়া করি। অনেকটা সময় পর্যন্ত সেই ভাষার আশ্রয়েই কেটে যায়।
বেড়ে উঠতে উঠতেই আমরা শুনি, হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা। তাহলে হিন্দিটা তো শিখতেই হয়। কিন্তু তাহলেও কি নিস্তার আছে?‌ কাজকর্মের ভাষা তো ইংরাজি। সাহেবরা চলে গেলেও এই ভাষাটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশিয়ে দিয়ে গেছে। রেশনের দোকান থেকে ট্রেনের টিকিট, মুদির দোকান থেকে ব্যাঙ্ক, সর্বত্রই এই ভাষা না জানলে সবকিছু অচল। অনেকে শুধু ফর্ম ফিলাপ টুকু শিখি। কিন্তু শুধু সেটা জানাই তো শেষ কথা নয়। তাই পদে পদে ঠোক্করও খেতে হয়।

spoken english
দিয়েগো মারাদোনা সারা পৃথিবী শাসন করেছেন। এখন লাওনেল মেসিও ফুটবল পায়ে শাসন করছেন। সারা পৃথিবী তাঁদের কথা শুনতে চায়, জানতে চায়। সব ভাষার কাগজেই তাঁদের নিয়ে লেখা হয়। তাঁদের কখনও ইংরাজি বলতে শুনেছেন?‌ তাঁদের দরকার পড়ে না। ইংরাজি না জানলেও তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বে আঁচড় পড়েনি। কিন্তু আমরা তো মারাদোনা বা মেসি নই। তাছাড়া, আমরা এমন একটা দেশে বাস করি, যেখানে দুশো বছরের উপনিবেশিক শাসনের হ্যাংওভার এখনও কাটেনি। বরং দিন দিন জেঁকে বসছে। একটু উচ্চতর শিক্ষার দিকে পা বাড়াতে গেলেই আমাদের ইংরাজি জানতেই হবে। না জানলেই বহির্বিশ্ব থেকে তো বটেই, নিজের চারপাশের চৌহদ্দি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব।
মোদ্দা কথা হল, ইংরাজিটা শিখতে হবে। কিন্তু একজন কিশোরের পক্ষে একসঙ্গে নিজের ভাষা, হিন্দি ভাষা আর ইংরাজি ভাষা— এই তিনটে ভাষা আয়ত্ব করা কতটা সম্ভব?‌ সে কি মাতৃভাষা ভুলে যাবে?‌ তার নিজের ভাষা কি তার চিন্তা চেতনা থেকে হারিয়ে যাবে?‌ সে কি ছোট থেকেই অন্য ভাষায় ভাবতে শিখবে?‌ সেই ভাষায় স্বপ্ন দেখতে শিখবে?‌ পরিবার থেকে, নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে?‌ ভাষাবিদরা এই নিয়ে অনন্তকাল ধরে তর্ক করছেন। জানি, এই তর্কের নিষ্পত্তিও নেই। কোনও স্পষ্ট সমাধানও নেই। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, আমরা কোনওভাষাটাই ঠিকঠাক শিখে উঠতে পারিনি। হিন্দি বলতে বলতে আটকে গেলে, দু লাইন ইংরাজি বলি। আবার একসময় সেই ইংরাজির দৌড় থমকে যায়। তখন আবার হিন্দিতে ফিরে আসা। বা নিজের ভাষায় ফিরে আসা। শুধু আমি–‌আপনি নই, তথাকথিত সেলিব্রিটিরাও এই রোগে আক্রান্ত।

হিন্দিকে আমরা যতই রাষ্ট্রভাষা বলি, দক্ষিণ ভারতের মানুষ কি তা মনে করে?‌ তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকে কি হিন্দি আদৌ গ্রহণযোগ্য?‌ সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য প্রভাবশালী মানুষেরা কি হিন্দিতে কথা বলেন?‌ এমনকী সেখানকার অভিনেতা, অভিনেত্রীরাও নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ। হিন্দির অত্যধিক ব্যবহারকে তাঁরা আগ্রাসন বলেই মনে করেন। হিন্দিকে তাঁরা চাপিয়ে দেওয়া ভাষা বলেই মনে করেন। এই অবস্থায় হিন্দি ভাষা দিয়ে কি গোটা দেশকে একসূত্রে গাঁথা সম্ভব?‌ বাকি ভারত অবশ্য হিন্দিকে এভাবে অস্পৃশ্য করে রাখেনি। তারা কাজচালানো হিন্দিটা শিখে নিয়েছেন। দেশের অধিকাংশ রাজ্যের নিজস্ব ভাষা আছে। তা সত্বেও সেই রাজ্যের মানুষেরা হিন্দিটা দিব্যি বুঝতে পারেন। কাজ চালানোর মতো বলতেও পারেন। পড়তে বা লিখতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। কিন্তু বোঝার ক্ষেত্রে সেই জড়তা নেই। কীভাবে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ল এই ভাষাটা?‌ সবথেকে বড় অবদান একটি যন্ত্রের। তা হল টেলিভিশন। এবং অবশ্যই হিন্দি সিনেমা। সহজ কথা, বিনোদনের হাত ধরেই হিন্দি ভাষাটা ঘরে ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র পেয়েছে।
কিন্তু ইংরেজি ভাষাটা সেভাবে ছড়াতে পারল না কেন?‌ কারণ, শুরু থেকেই সে এসেছে টেক্সট বুকের হাত ধরে। গম্ভীর স্বরে মাস্টারমশাই ক্লাসে পড়াচ্ছেন। না পারলে পিটুনি বা বকুনি, বা লোকলজ্জা। ভয়মিশ্রিত একটা প্রতিক্রিয়া নিয়ে ছাত্ররা পড়ছে। ভেতর ভেতর একটা হীনমন্যতা কাজ করছে। সেই কারণেই স্কুলে বা কলেজে ইংরাজি জড়িয়ে থাকলেও মনের ভেতর সেভাবে জায়গা পায়নি। ভাষাটার অনিবার্যতাকে আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু ভাষাটাকে ভালবাসতে পারিনি। ইংরাজি যদি শেখাতেই হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলাতে হবে। টেক্সট বুক বা ভয়ের আবহ নিয়ে নয়। সে আসুক হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে, ভালবাসার বার্তা নিয়ে।

bangla2
কীভাবে সেটা সম্ভব?‌ সহজ কথা, বিনোদনের জগতে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে ভাষাটাকে। ভারতে এত ভাষায় এত ছবি তৈরি হয়। কটা ইংরাজি ছবি তৈরি হয়?‌ ইংরাজি ছবি মানেই হলিউড কেন হবে?‌ ভারতের মাটিতে কেন মূলস্রোত ইংরাজি ছবি তৈরি হবে না?‌ অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, আমির খান, সলমন খান, অক্ষয় কুমারের মতো তারকারা কটা ইংরাজি ছবিতে অভিনয় করেছেন?‌ অমিতাভ বচ্চন যদি বাংলা ছবি করতে পারেন, তাহলে ইংরাজি ছবিতে আপত্তি কোথায়?‌ সেই ছবি যেন মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে না যায়। দুর্বোধ্য, জ্ঞান দেওয়ার ছবি না হয়ে ওঠে। সেই ছবির মধ্যে বিনোদনের পর্যাপ্ত উপাদানও থাকুক। আশির দশক বা নব্বইয়ের দশকে যখন গ্রামে গ্রামে টেলিভিশন ছড়িয়ে যাচ্ছে। রামায়ন ও মহাভারত — এই দুটো সিরিয়ালের হাত ধরেই পৌঁছে গেল গ্রামে গঞ্জে। যাঁরা হিন্দির কিছুই বোঝেন না, তাঁরাও দিব্যি টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিছুটা বুঝলেন, কিছুটা অনুমান করে নিলেন। সবমিলিয়ে মনের ভেতর একটা অনুরণন তৈরি হল। নিজের অজান্তেই একটু একটু হিন্দি সে আয়ত্ব করে ফেলল। জড়তার প্রাচীরটা গেল ভেঙে। পরের ধাপটা এগিয়ে দিলেন আমির, শাহরুখ, সলমনেরা।
ইংরাজিকেও যদি দেশের কার্যকরি ভাষা হয়ে উঠতে হয়, তবে এই জড়তার প্রাচীরটা সবার আগে ভাঙতে হবে। যেটা মানুষ বোঝে, যেখানে তার আগ্রহ, সেই পথটা নিতে হবে। তা ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ হতে পারে। ইউটিউবের ভিডিও ক্লিপিংস হতে পারে। এক পাতা ইংরাজি পড়ার চেয়ে বোধ হয় এক গ্লাস নিমের সরবত খাওয়া অনেক সহজ। মোবাইল–‌মগ্ন প্রজন্মকে তাহলে কী দিয়ে আকর্ষণ করবেন?‌ ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে তো অনেক সময় নষ্ট করি। রাতের বেলায় যদি চোখ বন্ধ করে অমিতাভ, মাধুরী দীক্ষিত বা আমির খানের ইংরাজি ইন্টারভিউ শুনি, তাহলে কেমন হয়?‌ চরিত্রগুলো পাল্টে যেতেও পারে, যার খেলায় আগ্রহ, সে শচীন, সৌরভ, রাহুল বা কুম্বলের সাক্ষাৎকার শুনতে পারে। সহজ ইংরাজিতে লেখা অডিও বুক ছড়িয়ে দেওয়া দেওয়া যেতে পারে। আরও কী কা উপায়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, ভাষাবিদরা ভাবুন। এত এত বছরের চেষ্টায় যা সম্ভব হয়নি, তা কিন্তু এক দু বছরের চেষ্টায় সফল হতে পারে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.