বৈশালী গাঙ্গুলী
দিনটি মার্চের শেষের তারিখ হবে। তপতীর হঠাৎ অনেকদিন পরে, ইচ্ছে করে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে, সকালটা মনের মত কাটাতে। তার শোবার ঘরের সবচেয়ে মনোরম জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সে।
জানালার বাইরের পৃথিবীকে মনোরম মনে হয়- কারণ জানলার বাইরের উঁচু গাছ, মুখোমুখি রাস্তা, আর রাস্তা পেরিয়ে একটি জগিং পার্ক- সবসময় অপূর্ব মনে হয়, তপতীর।
মাঝে দু পসলা বৃষ্টি হঠাৎ হওয়ায়, কলকাতার আবহাওয়া সকালে ঠাণ্ডা মার্চে; এ. সি চালাতে হচ্ছিল না। গত কিছুদিন ধরে, পরীক্ষার খাতা দেখতে, দেখতে ক্লান্ত সে।
সকালে হঠাৎ নেওয়া ছুটি- কি দারুণ ভাবে এক বুক ভর্তি ভালোবাসা নিয়ে আসে।
আহাঃ হঠাৎ পাওয়া সব বুঝি সুন্দর হয় এমনই !
====================
হঠাৎ করেই তো, স্কুলে নাইনে পড়তে, পড়তে খবর পায় তপতীরা যে ডাক্তার বাবা- অবনীবাবুর ডিব্রুগড়ের চা বাগান থেকে বদলি হয়েছে ডুয়ার্সে। তাই ওরা সবাই মামা বাড়ি শিলং পাহাড়ে থাকবে।
বারেক পয়েন্টে মামাবাড়িতে যেতে তপতী খুব ভালোবাসতো, তখন তার বয়স তেরো কিংবা চোদ্দ হবে।
ওই বার মামা বাড়ির উল্টো দিকের বাড়িটাতে একটি ওর বয়েসি মেয়ে নতুন করে এসেছিল, ওখানে গিয়ে জানতে পারে। বেশ ভাব জমে, অয়নার সাথে। একদিন পাহাড়ি রাস্তায় স্কুলের ভ্যান খারাপ হয়ে যাওয়ায় অয়না বলে, “চল না, হেঁটে যাই বাড়ি – গল্প করতে, করতে যাব!” হাঁটার সময় অয়নার আপেলের মত গাল দুটো লাল হয়ে যাচ্ছিল।
অয়না দারুণ ফর্সা, রূপবতী বলা চলে । মামিমা অবশ্য সাবধান করে, তপতীকে আগেই বলে রেখেছিল- মেয়েটি খুব একটা সুবিধার নয়। তপতী বোঝে, ‘মেয়েদের বড় শত্রু তো মেয়েরাই হয়।’ তাই বেশি গুরুত্ব দেয়নি। সেদিন কিন্তু সত্যি সন্দেহ হয় তপতীর, অয়নার ব্যবহারে-
হাঁটতে, হাঁটতে বলে-“তোকে কেউ আদর করেছে, চুমু খেয়েছে?” তপতী একদম ঘাবড়ে যায় প্রথমদিকে, এমন প্রশ্ন কি করে ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ে করতে পারে। এবার একটু সামলে নিয় বলে, “ওসব পছন্দ করি না রে! ” অয়না বলে, “ব’ল, এমন সুন্দর কোনও মুহূর্ত পাসনি। তাই বলি, তুই তো খারাপ না দেখতে, রঙ যদিও ফর্সা না- চোখ, মুখ বেশ ভালোই তো আছে, জানিস তোর শরীরের মায়া তোর চোখে আছে। দাদা আমার কলকাতার হোস্টেল থাকে কালকেই এসেছে। এসে, তোকে দেখেই তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছে। তার মানেই বুঝেছিস, তোর মধ্যে কিছু একটা অনবদ্য ব্যাপার আছে। দাদা আমার সব মেয়েদের কথা বলে না। দাদা, যদিও আমাদের থেকে এক ক্লাস বড়, কিন্তু দারুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলে- খুব নাক উঁচু- জানিস!”
কথাগুলো তপতীর মোটেও ভাল লাগছিল না। খুব তাড়াতাড়ি হেঁটেই বাড়িতে পৌঁছে যায় সেদিন।
এবার সারা রাত্রি জেগে, অয়নার কথাগুলো ভাবে। বারবার আহত করছিল, ওই কথাগুলো। মনে, মনে একটাই কথা চলছিল- ‘তার মানে মামিই ঠিক, অয়না ভাল নয়।’
আর কি, পরে অনেকদিন অয়নাকে একটু এড়িয়ে চলেছিল তপতী।
এড়াতেই হবে, কারণ ও স্কুলের মেয়ে হয়ে ওইসব কথা, যা তপতী নোংরা ভাবে, তাই বলেছে।
আর কোনওদিন ওদের বাড়িতে যায়নি, কেবল জানালা দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে অয়নাকে।
হঠাৎ একদিন- অয়না খুব দুঃখিত হয়ে আসে, তপতীর কাছে। জানা গেল ওদের পাড়ার একটি ছেলে, অয়নার প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু ওর হিটলার দাদা কলকাতা থেকে চাপ দিয়ে, ওদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করিয়ে দিয়েছে।
কথা বলে না, অয়না ওই ছেলেটার সাথে। আর কিছুদিন পরে, অয়নাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে ওদের বড়লোক বাবা, দাদার কাছে কলকাতাতে।
কেন জানি, সেদিন অয়নাকে ওরকম দুঃখিত দেখে তপতীর একটু মজা লেগেছিল।
তবে কি সে হীন্যমনতায় ভুগেছিল…। তবে কি ওইদিন ওর আসল রূপ অয়না বলে দেওয়াতেই, তপতী খারাপ পেয়েছিল। তার মানে, কোনও ছেলে তপতীকে প্রেম নিবেদন করেনি, তাই হয়তো অয়নার চারপাশে, ভালোবাসার আবেদন, প্রশংসা শুনে- মনে, মনে হিংসে করে খারাপ পেয়েছিল সে, অয়নাকে ।
সেদিন অনেক আদর করে, মুখের কথায় আশ্বস্ত করে, তপতী অয়নাকে বাড়ি পাঠায়।
কিন্তু হঠাৎ নিজেকে ঘৃণা করা শুরু করে।
======================
কয়েক বছর ওই শিলং পাহাড়ে কাটানোর পর, তপতীও চলে আসে কলকাতায়, পড়াশোনা করার জন্য। অয়নার সাথে যোগাযোগ ছিল না।
জানতে পেরেছিল, বারো ক্লাস পড়েই ও একটি মাদ্রাজি ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে চেন্নাই চলে গেছে।
অয়না নেই, তাই বলতে পারি নি তপতী- যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে থাকাকালীন- হঠাৎ একদিন সিনিয়ার মাস– কমের ফটোগ্রাফি স্পেশালাইজেসন করা, অংশুমান, ওর প্রথম বয়ফ্রেন্ড যেদিন, তপতীকে একটি খালি ক্লাসে নিয়ে, খানিকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে দরজার পেছনে, ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে কামিজের বোতাম খুলে- বুকের উপর হাত দিয়ে, আদর করে বলে-
“তপতী, আমি ছাড়া, অন্য কেউ যেন তোমাকে স্পর্শ না করে। তুমি আমার…” সেদিন সে বাড়িতে এসে, প্রথম সমস্ত শরীরকে জামা কাপড় ছাড়া আয়নার সামনে দেখে। মনে পরে যায় ওই, সেই দিনের অয়নার কথা-
“তোর মধ্যে কিছু অনবদ্য ব্যাপার আছে… “
হঠাৎ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, যেন তপতী নিজের অজান্তে নিজেকে ভালোবাসল, প্রথম।
===================== =
আজকে অনেক জল উপচে পড়ে অন্ধকার পথ ধরে চলে , নিবিড় সম্পর্কে বাঁচা শিখে গেছে তপতী। তের বছর হতে চলেছে বিয়ের । একটি স্কুলে এগেরো, বারো ক্লাস পড়ায় সে। ছাত্র-ছাত্রীরা খুব ভালোবাসে।
স্বামী রজত যদিও- নিজেকে, নিজের মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানির চাকরিকেই ভালোবাসে। প্রতি বছর ওরা বিলেতে বেড়াতে যায়! মেয়ে বড় কনভেন্ট স্কুলে সেভেনে পড়ে। তিনটে গাড়ি, চারটে ফ্ল্যাট আছে।
অথচ সেই তপতী কিন্তু ওই অংশুমানের ছোঁয়াকে ভুলতে পারেনি।
========================
মাঝে, মাঝে শিলং পাহাড়ে যায়, অংশুমানের সাথে দেখা করতে। বাবা অবনী এখন গৌহাটিতে অবসর নিয়ে বাড়ি করেছেন। তাই প্রতিবছর তপতী শিলং গিয়ে চার, পাঁচ ঘন্টা অংশুমানকে দিয়ে আসে- ওর বাড়িতে, মালা দেওয়া ছবির নিচে বসে।
=====================!
একদিন হঠাৎ তপতীকে গড়িয়ার বাড়িতে রেখে, বেহেলার বাড়িতে যাওয়ার পথে, একটি বাইকের সাথে ওর বাইকের ধাক্কা লাগে।
বন্ধবী মায়া ওই খবর ওকে দেয়। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, তপতী দৌড়ে বেরিয়ে যায়- অংশুমানের বাড়ির দিকে, দুই বছর ধরে চিনত যদিও- সেইদিন প্রথম তপতী অংশুমানের বাড়ি যায়। এর আগে, অংশুমান অনেকবার বলেছিল, তপতী লজ্জা পেয়েছিল- কারণ, সম্পর্কের ছয় মাসের মধ্যে, একদিন অংশুমান একটু আলতো করে ওর হাত ধরে বলে, “তোমাকে আমি সেই প্রথমদিন দেখেই ভালোবাসি।
অয়নাকেও তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম ।
আমার ক্যামেরার প্রথম ছবি তোমার। ওই জানলার ভিতরে তোমার চোখকে আমি বিভিন্নভাবে লেন্সে, ছেলেবেলা থেকেই ধরেছি। আজকে তুমি আমার এতো পাশে ভাবা যায়।” অয়নার দাদাই অংশুমান জানার পর লজ্জায় ওদের বাড়ি কোনদিনও যায়নি।
অংশুমানের দুর্ঘটনার কথা যেদিন তপতী শুনে, সেদিন প্রথম এপ্রিল ছিল। টেক্সিতে যাওয়ার সময় ভেবেছিল- বান্ধবী মায়া বোধহয় এপ্রিলফুল বানাচ্ছে।
অংশুমানের ফ্লেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তপতীর সব ভুল ভেঙ্গে যায়। অংশুমানদের বাড়ির ল’নে, অয়নাকে দেখে পাঁচবছর পরে- আর পাশেই অংশুমানের মৃতদেহ!
সেদিন তপতী, অয়নাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল।
====================
হঠাৎ কলিংবেল বাজাতে- তপতী আবার বাস্তবে চলে আসে। কাজের মেয়ে এসে বলল- কুরিয়ার এসেছে। তপতী কুরিয়ার খুলে দেখে- একটি সনদ, আর চেক এক লক্ষ টাকার, অয়না পাঠিয়েছে।
সাথে একটা চিঠি-
খুলে পড়ে তপতী-
“Dear তপতী,
মনে আছে বলেছিলাম, তোর মধ্যে কিছু অনবদ্য ব্যাপার আছে, দাদা তোর বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি তুলতো। আমি গতবছর পাঠাই- বার্লিনের আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফির একটি প্রতিযোগিতাতে। সেখানে প্রথম পুরস্কার পায় দাদার ছবি। দাদার মারা যাওয়ার পরে, তুই তো জানিস- মা, বাবা শিলং চলে যায়, ছবিগুলো আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। এইসব তোর প্রাপ্য, তাই তোকেই পাঠালাম।
তোকে ফোনে বললে, জানতাম তুই স্বীকার করবি না। তাই পাঠাচ্ছি। অনেক ভালোবাসা…
ইতি অয়না
=============
হঠাৎ আবার তপতীর মনে হল- ও কত ভুল মনে করেছে অয়নাকে।
আর ছবিগুলোকে আঙুল দিয়ে ধরে- আবার তপতীর মনে হল, অংশুমানকে স্পর্শ করল।
এবার জানলার বাইরে তাকিয়ে একটা বড় গাছ দেখে, কাজের মেয়েকে বলে-“ঝুনু ওটা কি নটে গাছ -“
“না বৌদি -ওটা তো দেবদারু গাছ, শুনেছি পাহাড়ে হয়। কি দুর্যোগ, পাহাড়ের গাছ কলকাতার বুকে।”
======================সেদিন তপতী মোবাইল খুলে ওর ভালোবাসার একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনেছিল-
“জানার মাঝে, অজানারে করেছি সন্ধান… বিস্ময়ে! তাই জাগে…!”
হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যায়, সামনে দেখে মেয়ে পুবালী, স্কুল থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। জড়িয়ে ধরে বলে-“মা কাঁদছো?” মমতার বাঁধন জড়িয়ে তপতী বলে-“হারানো জিনিস পেয়ে, খুশিতে চোখে জল এসেছে মা ! “
=====================
হঠাৎ বোধহয় সমস্ত পৃথিবী ঘরের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।