স্বরূপ গোস্বামী
জানি, এই হেডিংটা দেখেই আপনারা পড়তে শুরু করে দিয়েছেন। কারণ, এই বাংলায় এখন সবথেকে বড় সেলিব্রিটি আমি। হ্যাঁ, আমিই। সে আমাকে গুন্ডা বলুন, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলুন, জঙ্গি বলুন। যা খুশি বলুন। যতই ভারত–পাকিস্তান ফাইনাল থাকুক, সবকিছুকে টপকে শিরোনামে এখনও আমি। যদি ভারত জিতেও যেত, পারতেন আমাকে ভেতরের পাতায় পাঠাতে?
সবার কৌতূহল, আমি এখন কোথায় আছি? কেউ বলছে, পালিয়ে গেছি। না, কোথাও পালিয়ে যাইনি। পাহাড়ের মধ্যেই আছি। তবে, কোথায় আছি, বলব না। মাঝে মাঝে ভিডিও বার্তা ছাড়ছি। সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছিল। টিভি চ্যানেলের হাতেও পৌঁছে যাচ্ছিল। আমার হুঙ্কার সবাই জানতে পারছিলেন। কাল থেকে আবার পাহাড়ে সোশাল সাইটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি জানি, তবু আমার বার্তা ঠিক ছড়িয়ে যাবে। কী জানি, এবার হয়ত টিভি চ্যানেলকে বলা হবে, বিমল গুরুংয়ের বক্তব্য দেখানো চলবে না। দেখালে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেব। বাংলার বুদ্ধিজীবী, বাংলার চ্যানেল, বাংলার কাগজ— সব ব্যাটাকে চেনা হয়ে গেছে। দিদিমণি একটু চোখ রাঙালেই এরা সব গর্তে ঢুকে যায়।
অনেক কথা জমে আছে। অনেক কথা বলারও আছে। কিন্তু সব একবারে বলব না। তাহলে তো সব কথা ফুরিয়ে যাবে। তাই ভিডিও বার্তার মতো একেক দিন একেকটা কিস্তি যদি ছাড়ি, কেমন হয়! জানি, আমার বিরুদ্ধে অনেকের অনেক অভিযোগ। আমি বাংলা পড়তে পারি না। তবু এটুকু বুঝতে পারি, বাংলা কাগজগুলোয় আমাকে নিয়ে কী কী লেখা হচ্ছে। যে যা খুশি লিখছে, লিখুক। আমি পরোয়া করি না। পুলিশ এত লাঠি চালাচ্ছে, এত ধরপাকড় করছে, এত মিথ্যে মামলা সাজাচ্ছে। পারছে আমাদের মিছিল আটকে দিতে? কালকেও কী বিশাল মিছিল হয়েছে, কাগজে ছবি দেখে নিন। ভদ্রতা অনেক দেখিয়েছি। এবার আমাদের জঙ্গিপনাটাও একটু দেখুন।
আমাদের অপরাধটা কী বলুন তো? আলাদা রাজ্য চেয়েছি? খুব অন্যায় করেছি? এমন মনে হচ্ছে, গত কুড়ি বছরে যেন ভারতে নতুন রাজ্য হয়নি। গোয়া হল কীভাবে? ঝাড়খণ্ড হল কীভাবে? ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড হল কীভাবে? হাল আমলে তেলেঙ্গানা হল কীভাবে? তেলেঙ্গানার কথাই মনে করুন। কীভাবে তারা রাজ্য আদায় করল? তারা যতদিন শান্তিপ্রিয়ভাবে চেয়েছিল, সরকার শুনেছিল? তাদেরকেও গাড়ি পোড়ানো, অচল করে দেওয়া, বন্ধ ডাকা, ট্রেন আটকে দেওয়া–এসব পথেই হাঁটতে হয়েছিল। আমরাও তো গত পাঁচ–ছ বছরে অনেক জায়গায় দরবার করলাম। কী ফল হল? যতবার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গিয়েছি, চা–সিঙাড়া এসব খাইয়ে ‘দেখছি–দেখব’ বলে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের সরলতার ও ভালোমানুষির সুযোগ নিয়েছে। ওটুকুও করত না। নেহাত আগেরবার যশোবন্ত সিংকে এমপি করে পাঠিয়েছি, এবার আলুয়ালিয়াকে এমপি করে পাঠিয়েছি। তাই চা–বিস্কুট খাইয়েছে। ওদের দৌড় বোঝা হয়ে গেছে। ওরা দিদিকে চটাবে না। অনেক সেটিং–ফেটিং আছে। তাই আর নো চা বিস্কুট, নো আলোচনা। যে ভাষাটা কেন্দ্র বা রাজ্য বোঝে, সেই ভাষাতেই কথা বলতে হবে।
আরে বাবা, আমাদের এই দাবি কি আজকের? এটা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোনও দাবি নয়। একশো বছর আগেও এই দাবি ছিল। ষাট বছর আগে লোকসভায় এই দাবি উঠেছিল। সাতাশিতে এই দাবিতে পাহাড় উত্তাল হয়েছিল। তখন এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমি এত ইতিহাস–টিতিহাস বুঝি না। আমি এত বুদ্ধিজীবীও নই। দেখেছেন তো, কথা বলার সময় রোশনকে এগিয়ে দিয়েছি। টিভিতেও যাই না। আমি বুঝি, রাজ্য চাই, ব্যস। এর পেছনে এত যুক্তি–টুক্তি খুঁজতে গেলে আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী আছে। তারা বুঝিয়ে দেবে। আমাদের বারবার বলা হয়, শান্তি বজায় রোখো, পর্যটকরা আসুক। জিটিএ বলে একটা টোপ ঝুলিয়ে দেওয়া হল। বলা হল, অনেক উন্নয়ন হবে। ও বাবা, এ তো দেখি উল্টো কাণ্ড। টয়লেট উদ্বোধন, সেটাও দিদি এসে করে দিচ্ছে। নর্দমা হলে সেখানেও ফলক বসিয়ে দেবে। এতেও শান্তি নেই। পুরসভার দখল চাই, জিটিএ–তে দখল চাই। আরে বাবা, তোরা তো সব জায়গায় আছিস। এখানে না হয় আমরা রইলাম। তাও সহ্য হচ্ছে না! যদি বছরে একবার আসত, খবরদারি না করত, আমরাও মাথায় তুলেই রাখতাম। জঙ্গলমহলের কোন এক এসপি জঙ্গলের মা বলেছিল। আরে বাবা, আমি তো তার অনেক আগেই ‘পাহাড়ের মা’ বলেছিলাম (শেষপর্যন্ত একজন আইপিএস কিনা আমার মতো মাথামোটা লোকের কথাটা কপি পেস্ট করে দিল!)। বছরে একবার এলে আমিও মা, পিসিমা, দিদি, ঠাকুমা, সব বলে দিতাম। এমনকী বেশি টাকা দিলে দেবী দুর্গাও বলে দিতাম। গুচ্ছেক ছবি টাঙিয়ে দিতাম।
সব জায়গায় হোর্ডিং হল, পাহাড় হাসছে। আরে বাবা, হাসছে কার জন্য? আমি চুপচাপ আছি, সুবোধ বালকের মতো আছি, তাই হাসছে। অথচ, আমার কোথাও ছবি নেই। উল্টে কী বলা হল? আমাকে নাকি দিদি ঠান্ডা করে দিয়েছে। ভেবে দেখুন তো, আমার রাগ হবে না? আমি শান্ত রইলাম, বলা হচ্ছে আমাকে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। ঠাণ্ডাটা দেখেছিস, এবার আমি গরম হলে কেমন হয়, সেটা দেখ। আমরা একটু বিক্ষোভ দেখালাম। আমার ঘরে পুলিশ পাঠিয়ে দিল। জিটিএ দপ্তর সিল করে দিল। বিশ্বাস করুন, আমার লেজে পা না দিলে আমি এভাবে ফোঁস করে উঠতাম না। আমার কি এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে ভাল লাগছে! আমরা তো জিটিএ নিয়ে দিব্যি ছিলাম। তেমন অশান্তি তো পাকাইনি। জোর করে পুরসভা, জিটিএ দখল করতেই হবে? অডিটের লোক পাঠিয়ে দিল। এত এত পুরসভা আছে, কই সেখানে তো অডিট হচ্ছে না। আরও অনেক প্রশ্ন তোলাই যায়। বললাম যে, আমি এত বুদ্ধিজীবী নই। গান করতে, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে, ডাক্তারি করতে–কোনওটাই আমি পারি না। এসবের জন্য কেউ আমাকে মনেও রাখবে না। আমার নাম বাংলার লোক জানে পাহাড় অশান্ত করার জন্যই। মহাপুরুষেরা বলে গেছেন, তুমি যেটা পারো, সেটাই মন দিয়ে করো। আমিও বুঝেছি, ওসব জিটিএ–উন্নয়ন এসব আমার কম্ম নয়। আমি যেটা পারি, সেটাই মন দিয়ে করছি। আরও অনেক কথা আছে। সেগুলো অন্য কোনও সময় বলব।
(না, বিমল গুরুং কোনও একান্ত সাক্ষাৎকার দেননি। এই লেখাটিও তিনি লেখেননি। নানা সময়ে যা যা বলেছেন, এবং যা যা বলতে পারতেন, সেসব নিয়েই এই লেখা। নিতান্তই কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে মিল থাকলে তা মোটেই ‘কাকতালীয়’ নয়।)