মোহনবাগানে বাঙালদের অবদান কিন্তু কম নয়

মোহনবাগানের অনেক কিংবদন্তিই আছেন, যাঁরা জন্মসূত্রে বাঙাল। এগারোর ঐতিহাসিক শিল্ড জয় থেকে নানা সাফল্যে যাঁদের প্রচুর অবদান। তাই প্রশ্ন ওঠে, মোহনবাগান কি শুধুই ঘটিদের ক্লাব?‌ সেই পুরনো বিতর্ককে উস্কে দিলেন ময়ূখ নস্কর।। 

মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের নাম তো শুনেছেন, মোহনবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাবের নাম কখনও শুনেছেন? নিশ্চয়ই শোনেননি? আমিও শুনিনি, এই ফিচারটা লেখার জন্য ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল। আর চোখে যখন পড়ল, তখন এই ক্লাবটি কোথায়, কাদের ক্লাব, এই সব তথ্য আপনাদের না জানিয়ে পারছি না।
জানাব, কিন্তু তার আগে একটা কথার উত্তর দিন। এই যে আমরা কথায় কথায় বলি, মোহনবাগান ঘটিদের ক্লাব, ইস্টবেঙ্গল বাঙ্গালদের ক্লাব, মহামেডান মুসলমানদের ক্লাব- কথাটা কি ঠিক? ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নাম থেকেই এটা পরিষ্কার যে তারা মূলত পূর্ববঙ্গের লোকদেরই সমর্থক হিসাবে চায়। মহামেডানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। কিন্তু মোহনবাগানের নামে তো কোনও আঞ্চলিকতা বা ধর্মীয় গন্ধ নেই। তাহলে এটা কেন শুধু ঘটিদের ক্লাব হবে? এবং ইতিহাস বলছে মোহনবাগান কখনই শুধু ঘটিদের ক্লাব নয়। বাংলার পূর্বাঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে মোহনবাগানের সম্পর্ক বরাবরই নিবিড়। সেই নিবিড়তার গল্পের শুরুতেই শুনুন, ‘আমাগো দ্যাশের’ স্বাধীনতার এক আড়ালে থাকা অধ্যায়। ‘আমাগো দ্যাশ’ মানে বুঝতেই পারছেন, বাঙালদের ফেলে আসা দেশ (ব্যঙ্গ করে বলছি না, কারণ একদিন ওটা আমাদেরও দেশ ছিল), আজকের বাংলাদেশ।

mohun-bagan-history
সেই দেশের বাংলা নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কম-এর স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট ইয়াসির উবাইদ জিকোর লেখা ‘স্বপ্নদ্রষ্টার মুখে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গল্প’ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক না জানা কাহিনী। ১৯৭১ সালের জুন মাস। বাংলার মুক্তি পাগল মানুষ তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। ঠিক এই সময় একজন তরুণের স্বপ্নে গড়ে ওঠে একটি ফুটবল দল। গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত আদায় ও অর্থ সংগ্রহের জন্য। সেই দলের স্বপ্নদ্রষ্টার নাম সাঈদুর রহমান প্যাটেল। একজন ফুটবলার এবং মুক্তিযোদ্ধা। তার মুখ থেকেই প্রথম বের হয় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’-এর নাম। দেশে যখন যুদ্ধ চলছে তখন আবার ফুটবল কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে তিনি দেখা করলেন বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। সাঈদুর রহমান প্যাটেল বললেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য শিল্পীরা যেমন গান গাইছে তেমনই আমরা ফুটবলাররা ফুটবল খেলতে চাই।
তাজউদ্দীন আহমদের অনুমতি পাওয়ার পর যোগাযোগ করা হল ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ২৪ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর মাঠে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ প্রথম ম্যাচ খেলল স্থানীয় একাদশের বিপক্ষে। ওই দলটিতে ছিলেন ভারতীয় জাতীয় দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়। এর পর ৮ আগস্ট গোষ্ঠ পালের ক্লাবের বিপক্ষে খেলে বাংলাদেশের দলটি। আসলে গোষ্ঠ পাল একাদশ মূলত মোহনবাগান দলই ছিল। যুদ্ধের সময় হওয়ার কারণে নামটি পরিবর্তন করা হয়েছিল।
এ সমস্ত তথ্যই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার থেকে পাওয়া। আচ্ছা আপনারা কেউ বলতে পারেন, পশ্চিমবাংলায় এত ক্লাব থাকতে পূর্ব বাংলার দলটি কেন মোহনবাগানকেই বেছে নিল? কেন এত বছর পরেও সে দেশের মিডিয়ায় সেই খবর প্রকাশিত হয়? উত্তরটা খুবই সোজা। পূর্ববঙ্গের মানুষদের সঙ্গে মোহনবাগানের সম্পর্ক অনেকদিনের। সেই ১৯১১ সালে শিল্ড ফাইনাল দেখার জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে লোক এসেছিলেন কলকাতায়। ভিড় সামলানোর জন্য চালাতে হয়েছিল স্পেশাল ট্রেন, স্টিমার। সেই শিল্ডজয়ী দলের অনেকেই ছিলেন বাঙাল।
বাংলাদেশের মানুষ আজও সেই কথা স্মরণে রেখেছেন। সেদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’তে গতবছর শামসুজ্জামান খান ‘বাঙালির ফুটবল উন্মাদনা’ প্রবন্ধে লিখছেন, “ইংরেজের দুর্গ চুরমার করে কলকাতা মোহনবাগানের ঘরে উঠল আই এফ এ শিল্ড। মোহনবাগান ক্লাবের ১১ জন খেলোয়াড়ই ছিলেন বাঙালি এবং বাংলাদেশের দারুণ গর্বের ব্যাপার এই যে ১১ জনের ১০ জনই জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের বাঙাল।“
লেখক উত্তেজনার ঝোঁকে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। সেই অমর একাদশের ১০জন বাঙাল ছিলেন না। তবে অনেকেই ছিলেন। লেখক আরও জানাচ্ছেন, রামদাস ভাদুড়ি ছিলেন ঢাকার ওয়েলিংটন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। এই ভাদুড়ি পরিবারেরই সন্তান ছিলেন শিবদাস ও বিজয়দাস। পরবর্তীকালে ওয়েলিংটন ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওয়ারী। ওয়ারী ক্লাবের নাম এই আলোচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীনতার আগে মোহনবাগান ছাড়া পূর্ববঙ্গে যে দুটি ক্লাব জনপ্রিয় ছিল তার মধ্যে একটি হল এই ওয়ারী। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে বারবার এই ক্লাবটির নাম উঠে আসছে। মাহাবুবুর হাসান নীরুর প্রবন্ধ ‘আমাদের ফুটবলের বেলা অবেলা কালবেলা’য় দেখছি, “এ সময় ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও ওয়ারী ক্লাবই ছিলো প্রধান দুটো দল। সে আমলে এই ক্লাব দুটো শুধু ঢাকাতেই নয়, কলকাতাতেও আলোচনার ঝড় তোলে। ঢাকা এবং কলকাতার মাঠে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দলের বিরুদ্ধে নৈপুণ্যপূর্ণ ফুটবল প্রদর্শন করে দর্শকদের নজর কাড়ে এ দুটি দল।“ তিনি জানাচ্ছেন, ১৯১১-র শিল্ড জয়ী মোহনবাগান দলের দুই সদস্য যতীন্দ্রনাথ ওরফে কানু রায় এবং রাজেন সেনগুপ্ত প্রথম জীবনে ওয়ারী ক্লাবেই খেলতেন।

gostha pal
তবে এই ক্লাবটি মূলত হিন্দুদের সমর্থন পেত। আর মুসলমানরা সমর্থন করতেন মহামেডানকে। মাহাবুবুর হাসান নীরু জানাচ্ছেন, পূর্ববঙ্গের অনেক জায়গায় মহামেডানের বহু ইউনিট জন্ম নেয়। যার একটি হচ্ছে কুমিল্লা মহামেডান। পূর্ববঙ্গের যখন এই অবস্থা তখন পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা দেখে নিই। বাংলাদেশের এক লেখকের চোখ দিয়ে। ‘ফেলে আসা দিনগুলো’ নামক আত্মজীবনীমূলক লেখায় ইব্রাহিম হোসেন বলছেন, “ছাগলনাইয়া থানায় পানুয়া গ্রামে আমার জন্ম ১৯২৪ সালে। কিন্তু কখনও সেখানে আমার থাকা হয়নি। আব্বার বদলির চাকরিতে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। আব্বা যখন কলকাতার আলীপুর কোর্টে ম্যাজিষ্ট্রেট তখন আমি ভর্তি হই সেন্ট বার্নাবাস স্কুলে।… হিন্দুরা আমাদের বলত মোচলমান’; কেউ কেউ ভেংচিয়ে বলত ‘মোছলা’, ‘নেড়ে’। কিন্তু হিন্দুরা পরিচিত ছিল বাঙ্গালী বলে।…এই পার্থক্যটা সেকালে আরও বোঝা যেত খেলার মাঠে বিশেষ কোন ক্লাবের সাপোর্টারের ভিত্তিতে। যারা মোহনবাগান সাপোর্ট করত তারা বাঙ্গালী। যারা মোহামেডানের পক্ষে তারা মুসলমান।“
অর্থাৎ মোহনবাগান নিজেকে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের সঙ্গে যুক্ত না করলেও (ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের পর মুসলমানরা ব্যান্ড বাজিয়ে উৎসব করেছিল।) দেশ জুড়ে ক্রমশই সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়ছিল। আর মোহনবাগানের গায়ে লেগে যাচ্ছিল হিন্দুর তকমা। মোহনবাগান হয়ে উঠছিল হিন্দুদের ক্লাব।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন, সময়টা ১৯৩০-এর আগে-পরে, অর্থাৎ ততদিনে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই সময়ে কলকাতায় হিন্দুদের ক্লাব মোহনবাগান, পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে মোহনবাগান ছাড়াও জনপ্রিয় ওয়ারী, আর মুসলমানদের ক্লাব মহামেডান। তাহলে ইস্ট বেঙ্গলকে সমর্থন করত কারা?
একটু মাথা ঘামালেই বোঝা যাবে, সমর্থক সংখ্যার বিচারে ইস্টবেঙ্গল তখন নেহাতই ছোট, বড়জোর মাঝারি ক্লাব। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক বাড়তে শুরু করে দেশভাগের আগে পরে। ছিন্নমূল মানুষরা ইস্টবেঙ্গল নামটির মধ্যেই ফেলে আসা দেশের ছায়া খুঁজে পায়। দেশভাগের মতো দুঃখজনক ঘটনা না ঘটলে ইস্টবেঙ্গল আজও হয়তো ছোট বা মাঝারি ক্লাব হয়েই থাকত। মোহনবাগান, মহামেডান আর ওয়ারী হত বাংলার তিন বড় দল।
কিন্তু দেশভাগের পরে ওয়ারী বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল। মহামেডান মুসলমানদের ক্লাবেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। একমাত্র মোহনবাগানই থাকল মোহনবাগানে। আজও অসংখ্য মুসলমান, অসংখ্য বাঙাল মোহনবাগানের জন্য গলা ফাটান। শিবদাস,বিজয়দাস, গোষ্ঠ পাল, চুনির মতো বাঙাল খেলোয়াড়ের পাশাপাশি জ্যোতি বসু, আর ডি বর্মণের মতো মাঠের বাইরের বাঙালরাও মোহনবাগানকে কোনোদিন ভুলতে পারেননি।
আর ভুলতে পারেননি বাংলাদেশের সিলেটের তমজিদ আলি। এই আওয়ামী লীগ নেতার ক্লাবের নাম মোহনবাগান ক্রীড়াচক্র। ২০১৪-র ডিসেম্বরে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ওই ক্লাবের সভাপতি।

gostha pal2
আচ্ছা আপনারা কেউ বলতে পারেন, দেশভাগ, দাঙ্গা, এত বছরের ব্যবধান- তারপরেও তমজিদ আলি কেন মোহনবাগানের নামে তাঁর ক্লাবের নাম রাখলেন? মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার জন্য কৃতজ্ঞতা বোধে? না কি কোন পুরাতন প্রানের টানে?

সৌজন্যঃ প্রথম আলো, বাংলা নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকম, Mahaneebas.wordpress.com , www,shortstoryofBangladesh.com, Sabujsylhet.com

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.