চিঠির জন্য আলাদা একটা দিন আছে। পয়লা সেপ্টেম্বর। যেহেতু চিঠি লেখা হারিয়ে গেছে, তাই দিনটা নিয়েও তেমন হইচই নেই। চিঠি দিবসে চিঠির সেকাল–একাল নিয়েই আস্ত একটা লেখা। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
কত চিঠি লেখে লোকে
কত সুখে প্রেমে আবেগে স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।
সেই রানারও নেই। সেই চিঠির বোঝাও নেই। চিঠি নিয়ে এমন কত কবিতা, কত গান লেখা হয়েছে। সেই গানগুলোও এখন আর বাজে না। জীবন থেকে কতকিছুই হারিয়ে গেল।
একবার মনে করে দেখুন তো, শেষ কবে আপনার বাড়িতে চিঠি এসেছে। আরও একটু কষ্ট করে মনে করুন, আপনি নিজে শেষ কবে চিঠি লিখেছেন? কাকে লিখেছেন? মনে করতে পারছেন? স্মৃতির অ্যালবামে এমন কত ধুলো জমে আছে, কে জানে!
আমাদেরও একটা ছোটবেলা ছিল। সেই ছোটবেলার একটা বিরাট জায়গা জুড়ে ডাকপিওনও ছিল। প্রায় রোজই তাঁকে দেখতাম। সেই মাধবকাকু, পাড়ার প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি মানুষ যাঁর নখদর্পনে। আমার পাশের বাড়িতেই থাকতেন আমার মাস্টারমশাই। তাঁকে অধীর বক্সী বলেই জানতাম। কিন্তু তাঁর ভাল নাম যে নবগৌরাঙ্গ বক্সী, তা জেনেছি অনেক পরে। সিপিএমের এক দাপুটে নেতা ছিলেন, দিলীপ বক্সী। সবাই তাঁকে সেই নামেই চিনতেন। কিন্তু তাঁর নাম যে মৃণালকান্তি বক্সী, এটা বোধ হয় খুব অল্প লোকেই জানত। আশির দশক, নব্বইয়ের দশকে গুরু ভাণ্ডারকে চিনতেন না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। একবার কুইজে প্রশ্ন রেখেছিলাম, তাঁর আসল নাম কী? কেউই বলতে পারেনি সঠিক উত্তরটা। তাঁর নাম যে অবনীকান্ত হালদার, কে জানতেন? এমন কত না জানা উত্তর ছিল মাধবকাকুর কাছে।
এ তো গেল পুরুষদের কথা। আর বাড়ির বউদের নাম, সেই বুড়ি ঠাকুমার নাম। জানতেন একটা লোক, মাধবকাকু। তিনিই সবার মুশকিল আসান। খামের ওপর হাতের লেখা দেখে বলে দিতে পারতেন, এটা কার চিঠি। এমনকী চিঠির ভেতর কী থাকতে পারে, তাও খাম না খুলেই দিব্যি বলতে পারতেন।
আমার তখন ক্লাস ইলেভেন। বন্ধুদের মধ্যে উড়ো চিঠি লেখার একটা ধুম এল। যে যাকে পারছে, উড়ো চিঠি লিখছে। কোথাও পরামর্শ, কোথাও গালাগাল। কোথাও আবোল তাবোল। এমনই একটা চিঠি একদিন এল আমার ঠিকানায়। মাধবকাকু চাইলেই চিঠিটা বাড়িতে দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। একদিন দেখা হতেই ডাকলেন। হাতে চিঠিখানা ধরিয়ে বললেন, ‘এটা বাড়িতে দিইনি। হাতের লেখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে গালাগাল দেওয়া আছে। তোমারই কোনও বন্ধু হয়ত মজা করেছে। অনেকের বাড়িতেই এমন চিঠি আসছে।’ যা ভেবেছিলাম, তাই। চিঠিতে নানা বাক্যালঙ্কার অব্যয়। কে লিখেছিল, অনুমান করতে পারি। খুব যে রাগ থেকে লিখেছিল, এমন নয়, নিছক মজা করেই হয়ত লিখেছিল। আমাকে পাঠানো উড়ো চিঠিতে না হয় গালাগাল ছিল। কিন্তু এমন কত গোপন প্রেমের চিঠিও তো বিলি হয়েছে তাঁরই হাত দিয়ে। আমি নিশ্চিত, মাধবকাকু ঠিক বুঝতে পারতেন। সেগুলিও বাড়িতে না দিয়ে, যার চিঠি তাকেই দিতেন। এভাবেই কত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কে জানে!
সেই মাধবকাকুরা হারিয়ে যাচ্ছেন। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চিঠি লেখার অভ্যেসটাও। আর আপনি যদি কাউকে চিঠি না লেখেন, আপনাকেই বা লোক লিখবে কেন? এখন পোস্ট অফিস আছে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ বাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিন মাসে একবার, ইলেকট্রিক বিল দিতে গিয়ে। যে হারে সবকিছু অনলাইন হয়ে যাচ্ছে, ওটাও এবার মোবাইল বা ই মেলেই আসবে। তখন ডাকঘরের সঙ্গে শেষ যোগসূত্রটাও হারিয়ে যাবে।
বিজয়া এলে প্রণাম জানিয়ে কত পোস্টকার্ড সারা দেশে ঘুরে বেড়াত। ছুটে যেত এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ফোন আসায় লেখার প্রবণতা কমে গেল। তারপর সেই জায়গা নিল এস এম এস। এখন সেটাও যেন পুরনো। তাকেও বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়ে হাজির হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। নবমীর রাত থেকেই হোয়াটসঅ্যাপের বন্যা। আপনার মেসেজ বক্সে হয়ত একশো খানা ছবি, মেসেজ।
একটু ভেবে দেখুন তো, কোনওটাই কিন্তু শুধুমাত্র আপনার উদ্দেশ্যে নয়। অনেকটা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মতোই। একটা বিজয়ার ছবি। এক ক্লিকে পৌঁছে গেল সবার কাছে। সেই তালিকায় আত্মীয়রা যেমন আছেন, তেমনই স্কুলের বন্ধুরাও আছে। আছে না দেখা, না চেনা আরও কত লোক। অর্থাৎ, সেই না দেখা লোকের গুরুত্ব যা, আপনার গুরুত্বও সেই একই।
যতই প্রযুক্তি হানা দিক, যোগাযোগ যতই সহজ হয়ে আসুক, সত্যি করে বলুন তো, চিঠির যে রোমাঞ্চ, সেই রোমাঞ্চ খুঁজে পান? ‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম/রঙিন খামে যত্নে লেখা আমার নাম।’ বনশ্রী সেনগুপ্তর গাওয়া সেই গানে সেই চিঠি পাওয়ার রোমাঞ্চ। ‘প্যাহলে যব তু খত লিখতা থা/কাগজ মে চ্যাহরা দিখতা থা।’ হ্যাঁ, সেই চিঠির কাগজেই যেন অদৃশ্য ছবি ফুটে উঠত। সুদূর থেকে ছেলের চিঠি আসত মায়ের কাছে, স্বামীর চিঠি আসত স্ত্রীর কাছে। বাংলা সাহিত্যে, বাংলা সিনেমায় এমন কত দৃশ্য যে ছড়িয়ে আছে!
আমাদের জীবনেও কী এমন অনেক গল্প লুকিয়ে নেই! চিঠি পাওয়ার সেই রোমাঞ্চ কি আমাদেরও ছুঁয়ে যায়নি! এমন রোমাঞ্চের গল্প তো অনেকেরই আছে। বরং একটা বিড়ম্বনার গল্প শোনানো যাক। ক্লাস নাইন, আমি তখন হোস্টেলে। রোজ অনেকের চিঠি আসত। বিকেলে প্রার্থনার লাইনে নাম ডেকে ডেকে সেই চিঠি বিলি হত। যাদের চিঠি আসত, তারা বেশ বীরদর্পে সেই চিঠি আনতে যেত। আমার চিঠি আসত না, বেশ মন খারাপই হত। যাদের চিঠি দিচ্ছি, তারাও উত্তর দিচ্ছে না। চিঠি লিখলাম জীবন বিজ্ঞানের এক লেখককে (দুলাল চন্দ্র সাঁতরা)। এক মাস পেরিয়ে গেল, উত্তর আর আসে না। এক বন্ধু বুদ্ধি দিল, নিজেই নিজেকে চিঠি লেখ। সেই লেখক উত্তর দিলেন না তো কী হয়েছে? তাঁর হয়ে না হয় নিজেই চিঠি লিখব। তাই হল। সেই লেখকের নাম করে নিজের ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠালাম। দারুণ দারুণ জ্ঞান দেওয়া সেই চিঠি। চিঠি বিলির আগেই খবর ছড়িয়ে গেল, সেই লেখক আমাকে চিঠি দিয়েছেন। কত লোক সেই চিঠি দেখতে চাইল। আমিও পরম গর্বে সেই চিঠি দেখালাম। এরপরই আসল বিড়ম্বনা। সেই লেখক নিজের প্যাডে সত্যি সত্যিই একদিন চিঠি পাঠিয়ে বসলেন। খামের ওপরেও তাঁর নাম ছাপানো। সবার কৌতূহল বেড়ে গেল। চিঠি বিলির আগেই কেউ কেউ খুলে ফেলল। প্রেয়ার লাইনে সেই চিঠি বিলির আগেই ডাক পড়ল। কদিন আগেই ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি এসেছে, সেখানে এত যত্ন করে এত কথা লেখা। অথচ, লেখকের প্যাডে যেটা এল, সেটা নিতান্তই দায়সারা একটা চিঠি। ব্যাপারটা কী? চাইলে বানিয়ে এটা–সেটা বলে দেওয়াই যেত। কিন্তু বললাম, প্রেয়ার লাইনে এই চিঠি দেওয়ার দরকার নেই। হাতে হাতেই দিয়ে দাও। ফলে, পরের চিঠির কথা আর কেউ জানতেও পারল না। নকল চিঠির কথা সবাই জানল, আসল চিঠির কথা লুকিয়ে গেলাম। চিঠি নিয়ে এমন বিড়ম্বনায় আর কখনও পড়েছি বলে মনে পড়ছে না।
খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনে চিঠি লেখার অভ্যেস সেই ক্লাস সেভেন থেকে। ছাপা অক্ষরে নাম দেখতে বেশ রোমাঞ্চই লাগত। বন্ধনীর মধ্যে লিখে দিতাম সপ্তম শ্রেণী, নবম শ্রেণী। ছোট ছেলে ভেবে যদি ছাপে! হতও তাই। নামের পাশে বন্ধনীতে ক্লাস লেখা থাকত। চেনা–জানার বৃত্ত ছাপিয়ে সেই চিঠি পৌঁছে যেত জনতার দরবারে। ছাপা অক্ষরে নিজের নাম দেখা, সেও এক অন্য অনুভূতি। পরে হাজার হাজার লেখা ছাপা হলেও কৈশোরের সেই রোমাঞ্চের স্বাদই আলাদা।
ব্যক্তিগত চিঠির ক্ষেত্রেও কত স্মরণীয় মুহূর্ত। আসলে, চিঠির নাম শুনলে অনেকে ভয় পেয়ে যায়। কী লিখতে কী লিখব, কে জানে! যদি বানান ভুল হয়! কী লিখতে হবে, সেটাই অনেকে ভেবে পায় না। মনে পড়ে যাচ্ছে হোরাস ওয়ালপোরের লেখা কাহিনিতে সেই মহিলার কথা। যে তার স্বামীকে লিখছে, ‘আমার কোনও কাজ নেই, তাই আমি চিঠি লিখতে বসেছি। আমার কিছু বলার নেই, তাই শেষ করছি।’ এই বয়ানেও বেশ কয়েকজনকে চিঠি লিখেছিলাম। তারা মজা পেয়েছিল নাকি বিরক্ত হয়েছিল, সে তারাই জানে। যে সব বন্ধুরা দূরে থাকত, তাদের বেশি করে চিঠি লিখতাম। কারণ, তারা যেসব জায়গায় থাকত, বাংলা অক্ষরটুকুও দেখার সুযোগ থাকত না। তখন নিজের ভাষায় একটা চিঠি সেই প্রবাসী জীবনে যেন মাটির গন্ধ এনে দিত। এমন কত বন্ধুত্ব দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে সেই চিঠির সুবাদেই।
একবার সন্দীপ রায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সত্যজিৎ রায় ভোরে উঠে সবার আগে কোন কাজটা করতেন? সন্দীপ উত্তর দিয়েছিলেন, বাবা সবার আগে উঠতেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই বসে যেতেন চিঠি লিখতে। প্রত্যেকের চিঠির উত্তর দিতেন। নিজের প্রয়োজনেও কয়েকটা চিঠি লিখতেন। তারপর কাজ শুরু করতেন। অর্থাৎ, তাঁর দিনটা শুরুই হত চিঠি দিয়ে। মনে পড়ছে আরেক লেখক বুদ্ধদেব গুহর কথা। তিনিও নিয়মিত পাঠকের চিঠির উত্তর দিতেন। এবং তিনিও চিঠি লেখার কাজটা সকাল দিকেই করতেন।
আমরাও যদি এমনটা করতে পারতাম! রোজ সকালে অন্তত একটা করে চিঠি। যাকে খুশি। চারপাশে কত মুখই তো মনে পড়ে। রোজ নতুন নতুন একেকজনকে যদি লেখা যায়! কী লিখতে হবে, সেটা আপনিই ঠিক করুন। যা ইচ্ছে, তাই লিখুন। আপনারও ভাল লাগবে, যিনি পাবেন, তাঁরও ভাল লাগবে। বছর খানেক আগে গিয়েছিলাম আমার প্রিয় ডুয়ার্সে। অনেকবার একা গেছি, এবার সস্ত্রীক। রাজাভাতখাওয়ায় জঙ্গলের মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটা পোস্ট অফিস। এখনও সেখানে ‘রানার’ আছেন। পায়ে হেঁটে বক্সা পাহাড়ের ওপর রোজ চিঠি নিয়ে যান। ইচ্ছে হল সেই রানার দর্শনের। কিন্তু নির্জন সেই জঙ্গলে রানার পাওয়া গেল না। মনে হল, কয়েকটা পোস্ট কার্ড কিনলে কেমন হয়! কিনে ফেললাম। সেই পোস্ট অফিস চত্বরেই গাছের ছায়ায় বসে শুরু হল চিঠি লেখা। কিছুটা পাগলামিও বলতে পারেন। আমার স্ত্রী লিখল তাঁর মামাবাড়ির আশি পেরিয়ে যাওয়া দাদুকে। সেই জঙ্গলেই চিঠি পোস্ট হল। মাস তিনেক পর সেই চিঠি এসে পৌঁছল জীবনের পশ্চিম সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির কাছে। আপাত রুক্ষ সেই মানুষটিও যেন আবেগে ভাসা হারিয়ে ফেলেছেন। সম্ভবত, গত কুড়ি–তিরিশ বছরে এটাই তাঁর কাছে সেরা উপহার।
একবার ভাবুন তো, ২৫ পয়সার ছোট্ট একটা পোস্ট কার্ড কতকিছু বদলে দিতে পারে! হ্যাঁ, এই স্মার্ট ফোনের যুগেও সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। চিঠি দিবসের লেখায় এ কোনও গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ নয়। নিছকই এক খোলামেলা আড্ডা। হাতের স্মার্টফোনকে একটু সরিয়ে রেখে, সিরিয়াল বা রিল দেখাটা কয়েক মিনিটের জন্য মুলতুবি রেখে, লিখুন না একটা করে চিঠি।