হঠাৎ করেই যেন সাবালক হয়ে যেতাম

ছোটবেলার পুজো বলতে বারবার মনে পড়ে সরস্বতী পুজোর কথা। দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালির আবেগের শেষ নেই। কিন্তু কেন জানি না, সেই আবেগ ছোটবেলায় সেভাবে স্পর্শ করেনি। তার থেকে অনেক বেশি আপন মনে হত সরস্বতী পুজোকে। কারণ, এই পুজোর দায়িত্বে থাকত ছোটরাই। তারাই চাঁদা তুলত, তারাই ঠাকুর আনত, তারাই পুরোহিত ধরে আনত, তারাই বাজার করত, তারাই প্যান্ডেল থেকে প্রসাদ– ‌যাবতীয় আয়োজনের দায়িত্বে থাকত।

দুর্গাপুজোয় আমরা ছিলাম অনেকটাই ব্রাত্য। সেখানে নতুন জামাকাপড় পরা, পটকা ফাটানো– ‌এছাড়া আমাদের তেমন কোনও ভূমিকাই থাকত না। সোজা কথায়, আমাদের কেউ পাত্তাই দিত না। এখানে পাড়ার বড়রাই খবরদারি করত। ভাবখানা এরকম, তোরা পুঁচকে ছেলে। তোরা এসবের কী বুঝিস?‌ সরস্বতী পুজো এলেই হঠাৎ করে আমরা যেন সাবালক হয়ে উঠতাম। আমরাও পারি, এটা দেখিয়ে দেওয়ার, বুঝিয়ে দেওয়ার সেরা উৎসব ছিল এই সরস্বতী পুজো।

আমাদের না ছিল ক্লাব। না ছিল প্রেসে রসিদ ছাপানোর ক্ষমতা। মূলত সরস্বতী পুজোর কথা ভেবেই দোকানে রেডিমেড রসিদ বিক্রি হত। যা হোক একটা ক্লাবের নাম বসিয়ে দিতাম। চাঁদা তুলতে গিয়ে ভুয়ো রসিদ বিলি করা। পুলিশের গাড়ি দেখলেই দৌড় মারা। সেও এক অনাবিল আনন্দ। যার বাড়িতেই চাঁদা চাইতে যেতাম, ‘‌সরস্বতী’‌ বানান জিজ্ঞেস করত। পরীক্ষায় মোটামুটি কমন প্রশ্ন। কেউ একটা ভুল বানান বললে আর চাঁদা জুটত না। সেই কারণেই অনেক বানান ভুল হলেও এই বানানটা ছোট থেকেই মাথায় গেঁথে আছে।

সরস্বতী পুজোয় ছোটদের হাতেখড়ি হয়। কিন্তু পাড়ার প্যান্ডেলের পেছনে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার হাতেখড়িও কিন্তু সেই সরস্বতী পুজোতেই। প্যান্ডেলের পেছনে ছিল একটা ছোট্ট গোপন ঘর। সেখানেই কত নিষিদ্ধ কৌতূহলের জন্ম। সেই প্রথম রাতে বাড়ির বাইরে থাকার ছাড়পত্র। সারা রাত জেগে আড্ডা। সেই আড্ডায় তখনও সুরার প্রবেশ ঘটেনি। সিগারেটে একটা বা দুটো টান দেওয়া, এটাই ছিল বিরাট অ্যাডভেঞ্চার। সেই প্রথম একসঙ্গে রাত জাগা। সারা বছর সকালে স্নান করার কোনও বালাই নেই। কিন্তু এই সরস্বতী পুজো এলেই স্নান সেরে, নতুন পাঞ্জাবি গায়ে সাঁটিয়ে বেরিয়ে পড়া। কিশোরবেলার সেই লাজুক মুখ। শাড়ি পরে কে কে মণ্ডপে এল, আঁড়চোখে একটু জরিপ করে নেওয়া। প্রেমপত্র পকেটে নিয়ে পিছু নেওয়া। কিন্তু এত লোকের মাঝে কি আর দেওয়া যায়!‌ এই সঙ্কোচে কত কাঁচাহাতের প্রেমপত্র পকেটেই থেকে গেল। শেষমেশ আর দেওয়াই হল না।

আচ্ছা, মেয়েরা কি ছেলেদের এই মনোভাবের কথা বুঝতে পারত?‌ এখন বুঝি, আলবাত বুঝত। নইলে, তারাই বা এমন সেজেগুজে শাড়ি পরে আসত কেন?‌ কতজন পিছু নিচ্ছে, তারাও হয়তো মনে মনে হিসেব কষত। অন্য বান্ধবীদের সঙ্গে হয়তো কম্পিটিশনও করত। এখন বুঝি, কিন্তু তখন বুঝতাম না। বুঝলে এমন দুরুদুরু বুকে পিছু নিতাম না। সোশ্যাল মিডিয়ার আবহে প্রেম নিবেদনটা কত সহজ হয়ে গেছে। তবে, মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই লাজুক দিনগুলোই ভাল ছিল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.