বৃষ্টি চৌধুরি
আমাদের বেড়ে ওঠা আর আপনার গানের বেড়ে ওঠা প্রায় সমসাময়িক। আমাদের বেড়ে ওঠা মূলত নয়ের দশকে। বাংলা গান কোন খাতে চলছে, বোঝার মতো বয়স তখন হয়নি। যা গান চারপাশে বাজত, তাই শুনতাম। আশিকি, সাজন যেমন শুনতাম, তেমনি গুরুদক্ষিণা–অমরসঙ্গীও বেজে উঠত। বড় পিসি শুনতেন পুরানো বাংলা গান। আবার ছোট কাকা তখনকার নানা হিন্দি ছবির হিট গান। দুরকম গানই কানে আসত। গুনগুন করে সাজনের গানও গাইতাম, আবার লতা-সন্ধ্যার গানও গাইতাম।
সুমন তখন কিছুই বুঝতাম না। ভালও লাগত না। তুলনায় নচিকেতা বেশি নাড়া দিয়েছিল। মেয়েদের মধ্যে তখন অনেকেই রিমেক গাইতেন। বেশ কয়েকটা নাম মনে আছে। একটু একটু করে শুনলাম আপনার গান। একেবারে নতুন গান তো। একটু অচেনা ঠেকত। একদিন মঞ্চেও আপনার অনুষ্ঠান দেখলাম। হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গান গাওয়া নয়। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, একেবারে উদাত্ত কণ্ঠে। একেবারে যেন অন্য একটা ঘরানা। দেখতে দেখতে সেইসব গানের তিন দশক হয়ে গেল, তাই না!
তখন লিটল ম্যাগে দু একটা কবিতা লেখার হাতেখড়ি। অনেক কবিদের নাম জেনে ফেলেছি। হঠাৎ দেখলাম, জনপ্রিয় কবিতাগুলি একে একে গান হয়ে উঠছে। আবার আসিব ফিরে থেকে বেনীমাধব। শুরুতে কিছুটা খটকা লাগত। পরে দেখলাম, কানে দিব্যি সয়ে গেল। জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে ‘আবার আসিব ফিরে’ শুনতে তাঁরও ভালই লাগত। বেনীমাধব পড়েছেন যত না লোক, গান হিসেবে শুনেছেন তার থেকে ঢের বেশি লোক। আশা করি, জয় গোস্বামীও একমত হবেন। আসলে, আপনার গাওয়া বেনীমাধবের সুরটা কানে লেগে আছে বলেই গৌতম হালদারের সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা ভাল লাগেনি।
খুব আক্ষেপ করতাম, বাঙালি কবিতা শোনে না। কিন্তু সেই কবিতা বিমুখ বাঙালিই যেন একটু একটু করে কবিতাকে ভালবাসতে শিখল। কিছুটা কৃতিত্ব যদি ব্রততীর হয়, তবে গানের জগতে সেই কৃতিত্ব আপনাকেই দিতে হয়। আরও একজনের কথা বলতেই হয়, যিনি সবসময় আড়ালেই থাকতে চেয়েছেন, সেই সমীর চট্টোপাধ্যায়।
আপনার গানের সঙ্গে ওই নামটাও জড়িয়ে আছে। অথচ, মানুষটাকে সত্যিই কোনওদিন টিভিতে বা অন্য কোথাও আসতে দেখিনি। কোথাও তাঁর কোনও সাক্ষাৎকার পড়েছি বলেও মনে করতে পারছি না। তবে আপনার মুখে বারবার ওই নামটা শুনি। সম্প্রতি সেই মানুষটা চিরতরে হারিয়ে গেলেন। ভাল লাগে, খ্যাতি পেয়েও, প্রতিষ্ঠা পেয়েও ওই আড়ালের মানুষটাকে আপনি ভোলেননি। বারবার কৃতজ্ঞ চিত্তে তুলে এনেছেন সেই মানুষটার নাম।
মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়, আবার রাগও হয়। বাংলা ছবি আপনাকে সেভাবে ব্যবহারই করতে পারল না। ‘সেদিন চৈত্রমাস’ ছবির কথা মনে পড়ছে। আপনার কণ্ঠে অসাধারণ একটা গান দিয়েছিলেন সুমন—‘সূর্য তাকেই দেখতে চায়, আকাশ তাকেই ডাক পাঠায়।’ গানটি যেন আপনার জন্যই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরে আর সেভাবে ব্যবহার করা হল না কেন? কারা সঙ্গীত পরিচালনা করেন, তাঁরা কী চান, জানতে খুব ইচ্ছে করে।
গানের বাজারটাও দিনদিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। ক্যাসেটের দিন ফুরিয়ে গিয়ে এল সিডি। সেও চলে গেল কালের গর্ভে। এখন গান মানেই ইউটিউব। ডাউনলোডের দুনিয়ায় গান শোনার চেনা যন্ত্রগুলোই হারিয়ে গেল। কলেজে বা পাড়ায় সেই অনুষ্ঠানের চলও দেখি না। কারণ, কলেজে ভোট না করিয়ে যারা ক্ষমতায় আসছে, তারা আর যাই হোক, লোপামুদ্রার গান শুনবে না। সেই শিক্ষা, সেই রুচি কোনওটাই তাদের নেই। পাড়া বা ক্লাবে অনুষ্ঠানের যারা হোতা, সেই মানুষগুলোও তো বদলে গেছে। তারাই কি লোপামুদ্রা শোনে? মনে হয় না। সংস্কৃতির দুনিয়ায় বড় তাড়াতাড়ি যেন একটা শূন্যতা নেমে এল। ধামাধরা ‘অনুপ্রেরণা’জীবীদের ভিড়ে আপনাকে কখনই দেখা যায়নি। আপনি স্বতন্ত্র ছিলেন, আজও দিব্যি আছেন।
হতাশ হবেন না লোপা। আপনি যেমন আছেন, তেমনই থাকুন। গান নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যান। শুনলাম, কবিতা নিয়ে নাকি আর গান করবেন না। হয়ত হতাশা থেকে বলেছেন। হয়ত না ভেবেই বলেছেন। প্লিজ লোপা, কবিতা থেকে গান গাওয়া বন্ধ করবেন না। সমীরবাবু না হয় নেই। আর কেউ কি কবিতায় সুর দিতে পারবেন না? ঘরেই তো আছেন এক কৃতী সুরকার। একটু না হয় তাঁকেই ধমকে চমকে সুর করান। মন থেকে বিশ্বাস করি, জয় সরকার চেষ্টা করলে পারেন। সেই গান যদি তিনি অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়ানোর চেষ্টা করেন! কোমর বেঁধে ঝগড়া করুন। চিল চিৎকার করে পাড়া মাতিয়ে দিন। ওই গান আপনার, শুধু আপনার।
কবিতাগুলো বেঁচে থাক, নতুন করে প্রাণ ফিরে পাক আপনার কণ্ঠে।