আসল আসামী আড়ালেই থেকে গেলেন

রক্তিম মিত্র

‌একসঙ্গে এত মানুষের চাকরি চলে যাবে!‌ এমন রায় এই দেশে সম্ভবত হয়নি। আদালতের রায় ঠিক না ভুল, সে আইনজীবীরা বলবেন। কিন্তু এককথায় এই রায় কিছুটা যেন অমানবিক।
কেউ কেউ বলতেই পারেন, যারা অযোগ্য, তাদের চাকরি তো যাওয়াই উচিত। তাঁরা হয়তো তাঁদের জায়গায় ঠিক কথাই বলছেন। কিন্তু তারপরেও মন সায় দিচ্ছে না। বিশেষ করে সুদ–‌সহ মাইনে ফেরত দেওয়ার বিষয়টা।
এই তালিকায় অনেকেই আছেন, যাঁরা টাকার বিনিময়েই চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওয়েব মার্কশিট ভ্যানিস করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হয়তো ততখানি যোগ্য নন। তাঁদের চেয়েও যোগ্য লোকেরা আন্দোলন করছেন।
কিন্তু চাইলেই কি এত বছরের মাইনে ফিরিয়ে দেওয়া যায়!‌ কারও পক্ষেই সম্ভব?‌ কেউ হয়তো বাড়ি করেছেন। প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের ইএমআই দিতে হয়। শিক্ষকতার চাকরির সুবাদেই কারও হয়তো বিয়ে হয়েছে। ১)‌ চাকরি পাওয়ার সময় মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে। ২)‌ মাইনের পুরো টাকা নাকি ফেরত দিতে হবে। ৩)‌ সুদ–‌সহ ফেরত দিতে হবে।
একে তো চাকরি গেল। সামাজিক হেনস্থার চূড়ান্ত। শুধু তাঁর নিজের হেনস্থা নয়, একইসঙ্গে পরিবারের হেনস্থা। তারপর এত এত টাকা ফেরত দিতে হবে। না, এতবড় শাস্তি তাঁদের প্রাপ্য নয়। তাঁরা হয়তো অন্যায়ের সুযোগ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এতবড় অপরাধীও নন। যেখানে যোগ্যতার নিরিখে চাকরির দরজা প্রায় বন্ধ, যেখানে অনিয়মের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়, সেখানে একজন বেকার যুবক কীই বা করতে পারেন!‌ মেধায় যখন কাজ হচ্ছে না, যাঁর যোগাযোগ আছে, তিনি যোগাযোগ কাজে লাগান। দরকার হলে ধার করেও টাকা জোগাড় করেন।
কিন্তু এই রায়ের পর অনেকের কাছে বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও চলে যাবে। যাঁরা যোগ্য, তাঁদেরও লোকে সন্দেহের চোখেই দেখবেন। তাঁরা কী করে লোককে বোঝাবেন যে, তাঁরা যোগ্যতার ভিত্তিতেই পেয়েছেন?‌ মুড়ি মিছরি এক করে দেওয়া হল। কোর্টের যুক্তি, সব প্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। যাঁরা নষ্ট করলেন, প্রথম শাস্তি তো তাঁদের হওয়ার কথা। আগে তাঁদের শাস্তি ঘোষণা হোক। যিনি আড়ালের আসল মাথা, তাঁকেও তো সবাই চেনেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করা যাচ্ছে না?‌ তাহলে কীসের সিবিআই?‌ কীসের ইডি?‌ যাঁরা এতবছর ধরে তদন্ত করে অশ্বডিম্ব প্রসব করলেন, কেন তাঁদের শাস্তি হবে না?‌ অন্তত এই অযোগ্য শিক্ষকদের চেয়ে এই অযোগ্য সিবিআই আধিকারিকরা অনেক বেশি অপরাধী।
তদন্তের নামে সিবিআই কী করেছে?‌ গোটা কয়েক চারআনা, আটআনার এজেন্টকে ধরেছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আর ওপরে ওঠার চেষ্টা করেনি। সত্তর থেকে আশি শতাংশ টাকা যার পকেটে গেছে, তিনি সভা করে বেড়াচ্ছেন,ভাষণ দিচ্ছেন, হুঙ্কার দিচ্ছেন। না, তিনি মোটেই মুখ্যমন্ত্রী নন। মুখ্যমন্ত্রীর নৈতিক দায় নিশ্চয় আছে। কিন্তু আসল আসামী অন্য কেউ।
এই শিক্ষকদের শাস্তি দেওয়ার আগে সেই আসল আসামীকে শাস্তি দেওয়া কি আরও বেশি জরুরি ছিল না?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.