(আজ শিক্ষক দিবস। প্রিয় শিক্ষকদের স্মৃতিতর্পণ। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সুভাষচন্দ্র দে–র স্মৃতিতে তেমনই একটি লেখা। তুলে আনা হল ‘বনস্পতি’ স্মরণিকা থেকে)
স্বরূপ গোস্বামী
সবে মাধ্যমিক শেষ হয়েছে। হাতে অন্তত তিনমাসের সময়। আমাদের তখন পায় কে! সবাই যেন হাওয়ায় উড়ছি। এতদিন পরীক্ষার চাপে যা যা করতে পারিনি, তাই করব। কেউ ভাবছি, বেড়াতে যাব। কেউ ভাবছি, এই সুযোগে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলব। কেউ ভাবছি, সাইকেল নিয়ে টোটো করে ঘুরব। কেউ ভাবছি, মনের সুখে পুকুরে সাঁতার দেব। কেউ কেউ আবার ভাবছে, এখন থেকেই ইলেভেনের পড়াশোনা এগিয়ে রাখবে। এমন সময় একদিন স্যার ডেকে পাঠালেন।
যতদূর মনে পড়ে, আমরা সাত–আটজন তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কোন বিষয়ে কার কেমন পরীক্ষা হয়েছে, খুঁটিয়ে খোঁজ নিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, এই তিন মাস কে কী করতে চাও। অনেকেই কিন্তু কিন্তু করছিলাম। সব ইচ্ছের কথা কি আর স্যারের সামনে বলা যায়! উনিই আশ্বস্ত করলেন, ভয়ের কিছু নেই। তোমাদের যার যা মনে হচ্ছে, তাই বলো। সবাই যেন একটু একটু করে সাহস পেলাম। যার যা ইচ্ছে, বলেই ফেললাম। সবার সব ইচ্ছেকেই বেশ গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন। কাউকেই নিরুৎসাহিত করলেন না। বললেন, ‘বাপু, সত্যিই তো, গত এক বছর তোমাদের ওপর দিয়ে অনেক মানসিক চাপ গেছে। স্কুল, টিউশনি, বাড়িতে পড়া। রেজাল্ট বেরোলে একেবারে মহাসমুদ্রে গিয়ে পড়বে। তখন তো আরও ফুরসত পাবে না। এই তিনমাস তোমরা পুরোপুরি ছুটি কাটাও। এই তিনমাসের আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত কোরো না। যার যেটা ভাল লাগবে, যার যেটা ইচ্ছে হবে, সেটাই করবে। মন দিয়ে করবে। এখানে যেন কোনও ফাঁকি দিও না।’
জানতে চাইলেন, টেক্সট বইয়ের বাইরে কার কী পড়তে ভাল লাগে। কেউ বলল, ফেলুদা। কেউ বলল, খেলার পত্রপত্রিকা, কেউ বলল, কমিক্স। তারপর বললেন, ‘দেখ বাপু, তোমরা তো তোমাদের ইচ্ছের কথা বললে। এবার আমিও একটু আমার ইচ্ছের কথা বলি। তোমরা যে যেটা ভালবাসো, সেটাই করবে। পাশাপাশি এই তিনটে মাস একটু অন্যরকম বই পড়ো। যেগুলো হয়ত এতদিন পড়ে উঠতে পারোনি। মনে রাখবে, সিলেবাসের পড়া চিরদিন সঙ্গে থাকবে না। ওগুলো হয়ত একদিন ভুলেও যাবে। কিন্তু সিলেবাসের বাইরে যে পড়া, সেটাই হল আসল পড়াশোনা। এই তিন মাস তোমরা শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ— এই তিনজনের লেখা পড়ে ফেলো। পুরোটা হয়ত পারবে না। যতটা পারবে, ততটাই না হয় পোড়ো। এটা তো পরীক্ষার পড়া নয়। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পড়ার আনন্দেই পড়ো। একবার পড়তে শুরু করো। দেখবে, অদ্ভুত একটা আননদ পাচ্ছো। এমন আনন্দ, যা তোমাদের সারাজীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে। কেন পড়তে বলছি জানো? ১) পড়ার অভ্যেস তৈরি হবে। ২) দেখার চোখ তৈরি হবে। ৩) পরে হয়ত আর এগুলো পড়ার সুযোগ হবে না। এর মূল্য তোমরা এখন বুঝবে না। যখন বড় হবে, তখন বুঝবে।
আমরা সবাই তখন এই কথাগুলোর মানে বুঝেছিলাম, এমনটা মোটেই বলা যাবে না। কারও কারও মনে হয়েছিল, এত কষ্টে পড়া থেকে মুক্তি পেয়েছি, স্যার আবার বই নিয়ে বসতে বলছেন! যা হয়। যে যার মতো করে ছুটি কাটাতে বিভোর হয়ে গেলাম। কে কী পড়েছিল, জানি না। নিজের কথা অকপটে বলতে পারি। বঙ্কিম শুরু করে দুর্বোধ্য ভাষা দেখে তখনই নমস্কার করেছিলাম। বিভূতিভূষণ ছুঁয়ে দেখতেও পারিনি। তবে, শরৎচন্দ্র প্রায় শেষ করে ফেলেছিলাম। অদ্ভুত এক মাদকতা। কত রাত গড়িয়ে গিয়েছিল ভোরের দিকে। আজ এই মাঝবয়সে এসে মনে হয়, ভাগ্যিস অন্তত স্যারের কথা শুনে তখন শরৎচন্দ্র পড়া হয়েছিল। নইলে, পরে আর হয়ে উঠত কিনা কে জানে!
এমনই টুকরো টুকরো কত উপদেশ। কত স্নেহের শাসন। কত প্রেরণা ছড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে ভাবি, নিজে ইংরাজির শিক্ষক। অথচ, সেই কিশোরবেলায় বাংলা বই পড়ার পরামর্শ দিলেন কেন? গোটা কয়েক ভারি ভারি ইংরাজি বইয়ের নামও তো বলতে পারতেন। পরে বুঝেছি, শিক্ষক শিক্ষকই। তাঁকে কোনও ভাষায়, বা কোনও বিষয়ে মাপা যায় না। বাকি জীবনটাতেও তাঁকে সেভাবেই চিনেছি।
যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁদের কাছে নামটা নিয়ে আর ধোঁয়াশা থাকার কথা নয়। শ্রদ্ধেয় সুভাষচন্দ্র দে। সবার কাছে সুভাষবাবু। আমাদের কাছে এককথায় ‘স্যার’। ওই ছোট্ট শব্দটার কী ব্যাপ্তি, কী ওজন। সেই ভার সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন নদীর মতোই সহজিয়া স্রোতে। তাই জীবনের বন্ধন ছিন্ন করে যখন অন্য ভুবনে পাড়ি দিলেন, তখন বিষণ্ণতার পাশাপাশি ভিড় করছে একরাশ সুখস্মৃতিও।
একজন শিক্ষকের জীবনদর্শন ঠিক কেমন হওয়া উচিত। কেন জানি না, চোখ বুজলেই কয়েকটা খুব চেনা মুখ ভেসে ওঠে। সেই কিশোরবেলায় কতটুকুই বা বুঝেছিলাম। এখনও কি বুঝেছি? পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো এখনও যেন ছাড়িয়েই চলেছি। ভাবতে বসলেই ভাবনার ক্যানভাসে ধরা দেয় নতুন নতুন রঙ। ছড়িয়ে থাকে হাজার স্মৃতির ফোয়ারা। টুকরো টুকরো স্মৃতির তর্পণ। হয়ত নিতান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি। কিন্তু এ তো শুধু নিজের উপলব্ধি নয়। আরও হাজার হাজার ছাত্রের উপলব্ধিও তো সেই একই খাতে বইবে। তারপরেও উঠে আসে সেই প্রশ্নটা। এই মহাজীবনের কতটুকুই বা চিনেছি?
স্কুল শুরুর মিনিট পনেরো আগে হত প্রার্থনা সঙ্গীত। অনেকের মধ্যেই একটা রেওয়াজ ছিল, প্রার্থনা সঙ্গীত হয়ে যাওয়ার পর স্কুলে ঢোকা। কম–বেশি সবাই হয়ত এই রোগে আক্রান্ত ছিলাম। সেই তালিকায় পড়ুয়ারা যেমন ছিল, শিক্ষকরাও ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনও প্রার্থনা সঙ্গীতের পরে স্কুলে গেছেন, এমনটা শোনা যায়নি। যতদূর মনে পড়ে, একদিনই ক্লাসে বলেছিলেন, ‘বাপু, প্রার্থনাটাও স্কুলেরই অঙ্গ। দেরিতে আসার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। বরং নিজেকে একটা পরম আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছ। দশ মিনিট আগে এসো। দেখবে সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে নিজেরই ভাল লাগছে। কদিন এলেই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাবে।’ খুব সহজ করে বুঝিয়েছিলেন। পরদিন আর কারও দেরি হয়নি।
আসলে, প্রার্থনাটা নিছকই একটা উদাহরণ। এভাবেই সারাজীবন নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন অদ্ভুত এক নিয়মনিষ্ঠা ও শৃঙ্খলায়। যখন যে কাজটা করার, একটুও দেরি হত না। ঘুম থেকে ওঠা থেকে আবার রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত। তিনি ঘড়ি মিলিয়ে চলতেন নাকি তাঁর শৃঙ্খলা দেখে ঘড়ির কাটা নিজেকে মিলিয়ে নিত, বলা মুশকিল। যখন রেডিওর খবর শোনার, তখন খবর শুনেছেন। কাউকে ফোন করার দরকার, ঠিক সময় মেনেই করেছেন। এমনকী জীবনের প্রান্তবেলায় এসেও তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সন্ধে সাতটার ওষুধ ঠিক সন্ধে সাতটাতেই খেয়েছেন। সাতটা পাঁচ হয়নি। বারবার বলতেন, ‘যে কাজই করো, মনসংযোগটা খুব জরুরি। যখন যেটা করবে, মন দিয়ে করবে। দশটা কাজ শুরু করে অসম্পূর্ণ রাখার থেকে একটা কাজ কমপ্লিট করো। সেটা অনেক বেশি তৃপ্তির।’
তিনি পড়াতেন কবিতা আর নাটক। এমনই মরমী সে পাঠ, ইংরাজিকে ভিনদেশি ভাষা বলে মনে হত না। একটা নাটকের কথা মনে আছে। প্রোগ্রেস। মারণাস্ত্রের আবিষ্কারক এক বিজ্ঞানী প্রফেসর কুরি। আর যুদ্ধে সন্তান হারানো এক মা মিসেস মেলডন। দু’জনের কথোপকথনকে ঘিরেই নাটকের বিস্তার। মনে আছে, স্যার অনেকদিন ধরে এই নাটকটা পড়িয়েছিলেন। প্রতিটি সংলাপের পরতে পরতে যে বিস্ময়, রোমাঞ্চ, আতঙ্ক, উদ্বেগ রয়েছে, তার প্রতিটি স্তর কী নিপুণভাবে উন্মোচিত করেছিলেন। সেই প্রথম বুঝেছিলাম, ‘বিটুইন দ্য লাইন্স’ শব্দগুলোর আসল মানে কী। কথাই শেষ কথা নয়, তার আড়ালেও থাকে অনেক না বলা কথা, দীর্ঘশ্বাস। তখনই সেই কিশোর মননে যুদ্ধবিরোধী চেতনার নির্মাণ। তাই এত বছর পরেও যখন সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বাজানো হয়, যখন ইউক্রেনের আকাশে রুশ জঙ্গি–বিমান উড়ে যায়, মন ছুটে চলে সেই ক্লাস ইলেভেনে। সেই যুদ্ধবাজদের উদ্দেশে বলতে ইচ্ছে করে, ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল।’
তিনি কখনও কাউকে মারধর করেছেন? এমনটা দেখিওনি। শুনিওনি। কখনও রেগে গিয়ে কাউকে খুব কড়া ভাষায় অপমান করেছেন? এমনটাও মনে পড়ছে না। আসলে, এসবের দরকারই পড়েনি। জানতেন, ভালবাসার শক্তি এর থেকে ঢের বেশি। এই বিশ্বাসে একটি দিনের জন্যও ফাটল ধরেনি। আজীবন এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছেন। কোনও ছাত্রকে ‘তুই’ বলতেও শোনা যায়নি। মফস্বলের স্কুলে একটা চালু রেওয়াজ ছিল, পদবী ধরে ডাকা। অথবা, অমুকের ছেলে, অমুকের ভাইপো, এই পরিচয়ে ছাত্রকে চেনা। কিন্তু তিনি কাউকে পদবী ধরে ডাকতেন না। প্রত্যেকের নাম জানতেন। সবাইকে তার নাম ধরেই ডাকতেন। সেই ছাত্র স্কুল ছেড়ে যাওয়ার বহু বছর পরেও সেই নাম ভুলতেন না। কে কী করছে, সব খবর রাখতেন। তথাকথিত ‘ভাল ছাত্র’দের প্রতি শিক্ষকদের একটা বাড়তি দুর্বলতা থাকেই। ভাল ছাত্র মানে, যারা বেশি নম্বর পায়। যারা চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সুভাষবাবু ছিলেন এক মূর্তিমান ব্যতিক্রম। তাঁর চোখ শুধু ফার্স্ট বেঞ্চে নয়। লাস্ট বেঞ্চে বসা ছেলেটির প্রতিও একই স্নেহ, একই দরদ নিয়ে কথা বলেছেন। এই স্নেহে কোনও তারতম্য ঘটেনি। তাই যে ছেলেটি তথাকথিত ‘সফল’ নয়, বা বড়সড় চাকরি পায়নি, পরবর্তী জীবনেও তার প্রতি একই স্নেহ দেখিয়ে গেছেন। কখনও সেই ছাত্রর মধ্যে কোনও হীনমন্যতা তৈরি হতে দেননি। তাঁর বাড়ি ছিল ছাত্রদের অবারিত দ্বার। এমন স্নেহের আশ্রয় তো বড় একটা জোটে না। তাই চল্লিশ বছর আগে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যাওয়া ছাত্রও অবলীলায় হাজির হয়ে যেত। কখনও কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও সব খোঁজ নিতেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘বাপু, আবার এসো কিন্তু।’
তাই অনেকেই বারবার আশ্রয় খুঁজেছেন ওই বাড়িটায়। ওই মানুষটার কাছে। যে কোনও সমস্যায় যাওয়া যেত। একটা মরমী মন ছিল। যা দিয়ে সব অনুভব করতে পারতেন। না বললেও অনেককিছু বুঝতে পারতেন। তাই বলতেন, ‘বাপু, তোমাকে আজ কেমন যেন বিচলিত মনে হচ্ছে। সঙ্কোচ কোরো না। আমাকে বলতে পারো।’ অনেক সময় যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি, মনে হয়েছে ছুটে যাই ওই বটবৃক্ষের কাছে। বছর কুড়ি আগের কথা। কলকাতার একটি টিভি চ্যানেল বাঁকুড়ার স্কুলছাত্রদের নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করতে চায়। এত স্কুলছাত্র পাব কোথায়? পরামর্শের জন্য স্যারের কাছেই গেলাম। উনি সব সঙ্কোচ দূর করে দিলেন, ‘এটা নিয়ে এত চিন্তা করছ কেন? আমাদের স্কুলেই তো শুটিং হতে পারে। এ তো আমাদের কাছেও গর্বের বিষয়। তবে ওদের ক্লাসের যেন ক্ষতি না হয়, টিফিন পিরিয়ডে কোরো। ওই আধঘণ্টার মধ্যে হবে না!’ পরিচালককে জানালাম। তিনিও জানালে, আধঘণ্টাই যথেষ্ট। স্যারও ক্লাসে ক্লাসে নোটিশ পাঠিয়ে দিলেন, টিফিন পিরিয়ডে সবাই যেন সুশৃঙ্খলভাবে মাঠে আসে। এত সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটা সাজিয়ে দিলেন, সবার সহযোগিতায় আধঘণ্টার মধ্যেই সুন্দরভাবে শুটিং হয়ে গেল।
বছর পনেরো আগের কথা। রাঢ় আলাপন নিয়ে তখন প্রবল বিতর্ক। স্পষ্ট কথা লিখতে গিয়ে প্রায় সবাইকেই শত্রু বানিয়ে বসে আছি। আমাদের আক্রমণ কি একটু বেশি ঝাঁঝালো হয়ে যাচ্ছে? আমরা কি ভুল পথে হাঁটছি? সুর কি কিছুটা নরম করা দরকার? কাগজের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি অক্ষর খুঁটিয়ে পড়তেন। তাই সরাসরি একদিন জানতে চেয়েছিলাম স্যারের কাছে। পিঠে স্নেহের হাত রেখে বলেছিলেন, ‘তোমাদের বলার ধরনটা হয়ত একটু অন্যরকম। অনেকের খারাপ লাগতেও পারে। এটাই তো সাহস করে সত্যি কথা বলার সময়। বয়স বাড়লেই মানুষ আরও রক্ষণশীল হয়ে যায়। স্রোতের অনুকূলে তো সবাই ভেসে যেতে পারে। প্রতিকূলে ক’জন দাঁড় বাইতে পারে? তোমরা যে পথটা নিয়েছো, সেটাই সঠিক পথ। সঠিক সময়ে সঠিক অবস্থান নেওয়াটা খুব জরুরি। তবে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ কোরো না। প্রতিটি লেখা পড়ি, মনে মনে তোমাদের পিঠ চাপড়ে দিই। তোমাদের বিচারবুদ্ধির ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। যেটা সঠিক মনে করবে, সেটাই লিখবে। আজ হয়ত লোকে ভুল বুঝবে। কিন্তু একদিন না একদিন তারা ঠিক বুঝবে।’ বুকের ভেতর জমে থাকা পাথরটা যেন হঠাৎ করে সরে গেল।
আবার সেই স্কুলজীবন। তখন ক্লাস ইলেভেন। সেই সময় যা হয়। ছোট ছোট দুষ্টুমিকেই বিরাট অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়। পুজোর গন্ধ এসে গেল মানেই এদিক–ওদিক চকোলেট বোমের আওয়াজ। অতি উৎসাহী কেউ কেউ স্কুলেও এমন অ্যাডভেঞ্চার করত। একবার টিফিন পিরিয়ডের পর বেশ কয়েকটা বোমার শব্দ। হুলুস্থুল পড়ে গেল। কে ফাটিয়েছে। ধরা পড়লেই হয়ত মোক্ষম শাস্তি। স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যাপারটা একসময় থিথিয়ে গেল। অনেক পরে সেই ছেলেটির কাছেই শুনেছিলাম, সেই ছেলেটিকে একান্তে ‘স্যার’ ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাপু, ক্ষুদিরামও বোম ছুঁড়েছিল। ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিল। আজ ইতিহাসে তার কথা পড়ানো হয়। তুমিও বোম ফাটিয়েছো। কিন্তু লজ্জায় স্বীকার করতে পারছ না। এবার বুঝলে তো দুটো বোমের ফারাক কতটা।’ ছেলেটি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। কান্নার কী অদ্ভুত সংক্রমণ। স্যারের দু’চোখেও তখন জল। মনে পড়ে যাচ্ছে রবি ঠাকুরের সেই কবিতা— দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে/সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। সেদিন কেউ দণ্ডিত ছিল না। কেউ দণ্ডদাতাও ছিলেন না। দুই চোখের জল কোথায় যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল।