সরোজ চক্রবর্তী
দেওয়াল লিখনটা পরিষ্কার ছিল আগের ম্যাচেই। রোনাল্ডো দলে থাকার পরেও তাঁকে প্রথম দলে রাখা হল না! কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোস যতই স্ট্র্যাটেজি বলে চালান, কারণটা যতটা ফুটবলের, তার থেকেও বেশি মনস্তাত্বিক। আসলে, তিনি রোনাল্ডোকে একটা বার্তাই দিতে চাইলেন। বোঝাতে চাইলেন, তুমি নিজেকে অপরিহার্য মনে কোরো না। আমার কাছে তোমার বিকল্প আছে। তোমাকে ছাড়াও আমরা দিব্যি জিততে পারি। বরং আরও ভালভাবে জিততে পারি।
ভেবেছিলাম, একটা ম্যাচের পর কোচ হয়ত নিজের জেদ থেকে সরে আসবেন। কোয়ার্টার ফাইনালে ঠিক রোনাল্ডোকে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু দেখা গেল, এই ম্যাচেও সাইডলাইনে বসে রোনাল্ডো। নামানো হল দ্বিতীয়ার্ধে। চ্যাম্পিয়নরা এমন পরিস্থিতিতেই জ্বলে ওঠেন। জবাব দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করেন। কয়েক বছর আগে হলে রোনাল্ডোও হয়ত উপেক্ষার যোগ্য জবাব দিতেন। কিন্তু এই রোনাল্ডোর মধ্যে সেই স্ফুলিঙ্গ আর নেই। তাই জবাব দেওয়ার এমন পটভূমিতেও জ্বলে উঠতে পারলেন না। নেইমারের মতো তাঁকেও বিদায় নিতে হল। নেইমারের যা বয়স, তাতে তাঁর সামনে পরেরবার একটা সুযোগ থাকতে পারে। রোনাল্ডোর সামনে আর সেই সুযোগটাও নেই।
রোনাল্ডো নিজেও অবশ্য এমন পরিণতি ডেকে এনেছেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই অযাচিত বিতর্ক ডেকে আনলেন। ক্লাব ফুটবলের প্রসঙ্গ টেনে এনে আক্রমণ করে বসলেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড কোচকে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করলেন, ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে গেল। বিশ্বকাপের ঠিক আগের মুহূর্তে নিজের ফোকাসটাই হারিয়ে ফেললেন। অনেকে বলেছিলেন, রোনাল্ডো পেশাদার ফুটলার। এসব ঘটনায় কোনও প্রভাব পড়বে না। তাঁরা ভুলে যান, রোনাল্ডো একজন রক্তমাংসের মানুষ। তাঁর মনের মধ্যেও বিতর্কের ঝড় উঠতে বাধ্য। ফোকাস যে ঠিকঠাক ছিল না, তা তো বিশ্বকাপ জুড়েই বোঝা গেল। দলের মধ্যে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। কোচের সঙ্গেও বিতর্কে জড়ালেন। জল্পনা ছড়াল, তিনি নাকি বিশ্বকাপ চলাকালীনই শিবির ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। এই জল্পনাকে যতই ভিত্তিহীন বলে ওড়ানো হোক, কিছু সত্যতা তো নিশ্চয় ছিল।
কিন্তু সবথেকে খারাপ লাগল ম্যাচের পর পর্তুগাল কোচের প্রতিক্রিয়া দেখে। আগের ম্যাচে তাঁর স্ট্র্যাটেজি ক্লিক করে গিয়েছিল। অখ্যাত ফার্নান্দো র্যামোস এসে হ্যাটট্রিক করে সে যাত্রায় কোচের মান বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বারবার হওয়ার নয়। একই তাস বারবার কাজ করে না। তাই আগের ম্যাচে যদি কৃতিত্ব নিতে হয়, এই ম্যাচে হারের দায়ও একান্তই কোচের। রোনাল্ডোকে শুরু থেকে না নামাতেই পারেন। কিন্তু ম্যাচের পর তিনি কিনা বলে বসলেন, ‘রোনাল্ডো কী করল, তা তো আপনারা সবাই দেখলেন। এ নিয়ে নতুন করে আর কী বলব। ওকে নামাইনি, এর জন্য কোনও আক্ষেপ নেই।’
সবাই জানেন, এটা রোনাল্ডোর শেষ বিশ্বকাপ। এই নিয়ে দেশের জার্সি গায়ে পাঁচবার বিশ্বকাপ খেললেন। পাঁচবার ব্যালন ডিওর জিতেছেন। হতেই পারে, এখন আগের ছন্দে নেই। হতেই পারে, তাঁকে প্রথম দলে রাখা গেল না। কিন্তু বিদায়বেলায় কাটা ঘায়ে এমন নুনের ছিটে না দিলেই পারতেন। এমন বিদায় অন্তত রোনাল্ডোর প্রাপ্য ছিল না।