এই প্রথম দুই মহাতারকার আসল লড়াই

সরোজ চক্রবর্তী

দুই বড় শক্তি মুখোমুখি হওয়ার আগে শুধু দেশ বনাম দেশ নয়, আরও অনেক আঙ্গিক এসে হাজির হয়ে যায়। ‌কোচ বনাম কোচ। অধিনায়ক বনাম অধিনায়ক। দুই দলের সেরা তারকার তুলনা টানতে গেলে কিছু মিল, কিছু অমিল চলে আছে। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্বে এসে এতগুলো মিল পাওয়া যাবে, সত্যিই ভাবা যায়নি। এই মিলগুলো নেহাতই কাকতালীয় মনে হতে পারে।

আগেই বলে নেওয়া যাক, দুই দলের সেরা তারকা কারা?‌ আর্জেন্টিনা বললেই যেমন লিওনেল মেসির কথা ভেসে ওঠে, তেমনই ক্রোয়েশিয়া বললে ঘুরেফিরে একটা নামই আসে— লুকা মডরিচ। মিলগুলোয় একটু চোখ বোলানো যাক। ১)‌ দুজনেই দলের অধিনায়ক। ২)‌ মেসির বয়স ৩৫, মডরিচের ৩৭। দু’‌বছর ফারাকটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল, দুজনেরই এটা শেষ বিশ্বকাপ। ৩)‌ দুজনেরই জার্সি নম্বর দশ। ৪)‌ লিওনেল মেসিকে বলা হয় এল এম টেন। কী আশ্চর্য, লুকা মডরিচও সেই এল এম টেন। ৫)‌ একজন দীর্ঘদিন খেলছেন এসি মিলানে, অন্যজন বহু বছর বার্সিলোনায়। দুজনেই নিজের দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়েছেন। ৬)‌ দুজনেই পেয়েছেন ব্যালন ডিওর পুরস্কার। ৭)‌ মেসি ২০১৪–‌র বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়, মডরিচ ২০১৮–‌র সেরা খেলোয়াড়। ৮)‌ সোনার বল পেলেও দুজনেই ট্র‌্যাজিক হিরো। দুজনেই নিজের দেশকে ফাইনাল পর্যন্ত তুলতে পেরেছেন। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননি। দু’‌জনের সামনেই এটাই শেষ সুযোগ। ৯)‌ কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সেমিফাইনাল। দুই দলই উঠেছে টাইব্রেকারে জিতে। ১০)‌ দু’‌জনের বেড়ে ওঠার পেছনে রোমহর্ষক লড়াইয়েও মারাত্মক মিল। মেসি একেবারে শৈশব থেকেই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। বাচ্চা বয়সেই দেশ ছেড়ে ঠাঁই নিতে হয় বার্সিলোনার অ্যাকাডেমিতে। আর মডরিচ তো ছোটবেলাতেই নিজের বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখেছেন। ঘর ছেড়ে তাঁরও ঠাঁই হয়েছিল শরণার্থী শিবিরে।

এবার বিশ্বকাপে এত লড়াই হল। আর কোনও লড়াইয়ে দুই মহাতারকার মধ্যে এমন মিল ছিল?‌ সুতরাং লড়াইটা যেমন আর্জেন্টিনা বনাম ক্রোয়েশিয়ার, তেমনই লড়াইটা মেসি বনাম মডরিচেরও। মেসিকে বরাবরই শুনতে হয়েছে, ক্লাবের হয়ে যতখানি সফল, দেশের হয়ে ততখানি সাফল্য নেই। আর্জেন্টিনা এর মধ্যেই দুবারের চ্যাম্পিয়ন (‌১৯৭৮, ১৯৮৬)‌। তার ওপর কথায় কথায় মেসির তুলনা চলে আসে কিংবদন্তি মারাদোনার সঙ্গে। বলা হয়, মারাদোনা দেশকে বিশ্বকাপ দিয়েছে, তুমি তো দিতে পারোনি। মডরিচকে অবশ্য এতখানি প্রত্যাশার চাপ কাঁধে নিতে হয় না। তাঁর দেশ শেষ চারে উঠে আসা মানেই বিরাট এক ব্যাপার। তবে গতবার ফাইনালে ওঠার পর প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে। এবার নিশ্চয় ক্রোয়েশিয়া প্রথমবারের জন্য ট্রফি ঘরে তুলতে মরিয়া থাকবে।

মুখোমুখি লড়াইয়ের একটা পরিসংখ্যান এসেই যায়। বিশ্বকাপে মুখোমুখি লড়াই হয়েছে দু’‌বার। সেখানে ফলটা ১–‌১। ৯৮ বিশ্বকাপে ১–‌০ তে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। গত বিশ্বকাপে কিন্তু ৩–‌০ গোলে জয়ী হয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। আর খেলা যদি টাইব্রেকারে গড়ায়, তাহলে পরিসংখ্যান ক্রোয়েশিয়ার দিকে অনেকটাই একপেশে। টাইব্রেকারে তাঁরা নাকি অপ্রতিরোধ্য। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলছে। আর্জেন্টাইন কোচ স্কালোনির নিশ্চিতভাবেই কিছু পরিকল্পনা থাকবে মডরিচকে ঘিরে। কিন্তু মেসিকে ঘিরে ডালিচ কী ভাবছেন?‌ ক্রোয়েশিয়ার কোচ সাফ জানালেন, ‘‌মেসিকে তো আজ নয়, অনেকদিন ধরে দেখছি। ওর খেলার ধরন হয়ত অনেকটাই জানি। কিন্তু ও এমন একজন ফুটবলার এক মুহূর্ত সুযোগ পেলেই ম্যাচের রঙ বদলে দিতে পারে। ও যে সমবসময় সামনে থাকছে, তা নয়, অনেক সময় পেছন থেকেই ঠিকানা লেখা পাস বাড়াচ্ছে। দ্রুত জায়গা বদল করছে। ওকে আটকাতে তাই জোনাল মার্কিং ছাড়া কোনও উপায় নেই। হয়ত তারপরও অনেক ফাকফোকর থেকে যাবে। তবু আমরা আমাদের দিক থেকে যতটা করতে পারি, সেই চেষ্টায় যেন ত্রুটি না থাকে।’‌

সবমিলিয়ে প্রথম সেমিফাইনালে বেশ উপভোগ্য লড়াই হতে চলেছে। ধারেভারে, জনসমর্থনে নিশ্চিতভাবেই আর্জেন্টিনা এগিয়ে। কিন্তু যারা আগের ম্যাচে ব্রাজিলকে হারিয়েছে, যারা গতবারের রানার্স, সর্বোপরি, যাদের দলে লুকা মডরিচ আছেন, তাদের উপেক্ষা করা যায়!‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.