ভোটাদা,  অযোধ্যার বিস্ময়মানব

শান্তনু পাঁজা

যে কোনও জায়গায় বেড়াতে গিয়ে আমাদের কত অভিজ্ঞতাই না হয়, কত অমূল্য স্মৃতিই না আমাদের সঙ্গী হয়। এই স্মৃতি, অভিজ্ঞতা আর কিছু বিশেষ অনুভূতি, এইগুলোর জন্যই তো আমরা ভ্রমণ পিপাসুরা মানুষেরা পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে চলা ফেরা করি, তাই না? এইরকমই এক স্মৃতির কথা বলব যা আমার জীবনকালে আমি কোনওদিন ভুলব না।

পুজোর ছুটিতে আমরা তিন মূর্তি (আমি আর আমার দুই বন্ধু যাকে বলে জিগরি দোস্ত আরকি) প্ল্যান করলাম বাইকে পুরুলিয়া যাব। কথামতো অযোধ্যা পাহাড়ের খুব কাছে নিরিবিলি পরিবেশে একটা রিসর্ট বুক করলাম। সপ্তমীর দিন সকাল সকাল মা দুগ্গার নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার হয়েছিল, ভাবটা এরকম যেন ছেড়ে যাচ্ছি বলে আমার শহর কলকাতা আমার উপর অভিমান করেছে। ঠিক করলাম মুম্বাই হাইওয়ে ধরে খড়্গপুর হয়ে ঝাড়গ্রাম–‌বেলপাহাড়ি হয়ে যাব। মনটা বেশ খুশি খুশিই ছিল। কথা ছিল ঝাড়গ্রামে আমাদের তিন মূর্তির এক মূর্তির বাড়িতে পেটপুজো করে পুরুলিয়ার দিকে পাড়ি দেব। সমস্ত পথে মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে পূজা মণ্ডপ গুলোর গান আর ঢাকের বাদ্দি শুনতে শুনতে চলেছি। আমার মনটাও খুশিতে আকাশে উড়ছিল, ঠিক যেমনটা আমার পক্ষীরাজ, আমার বাইকটাও ঝড়ের বেগে চলেছিল। ঘুমের মধ্যে মিষ্টি স্বপ্ন দেখতে দেখতে যেমন হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, আমারও ঠিক তাই হল। আমার avenger হঠাৎ করে বিকট যান্ত্রিক আর্তনাদ করতে করতে থেমেই গেল। খড়্গপুর পৌঁছাতে তখনও ৩ কিলোমিটার বাকি। কভার খুলে দেখলাম ব্যাটারি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। পড়লাম মহা ফাঁপরে। হাইওয়ের ধারে, সুনসান জায়গা কোথাও কোনও বাড়ি, ঘর, দোকান কিছুই চোখে পড়ছে না। গাড়ি ঠেলে সামনে এগোনো ছাড়া কোনও উপায় দেখলাম না। কপাল গুনে একটু দূরেই একটা চায়ের দোকান পেলাম। চা দোকানের লোকটা জানাল একটা মেকানিক দোকান আমরা ফেলে এসেছি সেটা বেশি দূরে নয়। বুকে বল পেয়ে গাড়ি ঘোরালাম উল্টো পথে। দোকানটা পেয়েও গেলাম কাছেই। সব দেখেশুনে মেকানিক ভাইটি বলল, ব্যাটারি বদলাতে হবে। প্রায় ঘন্টা খানেক বসে থেকে কাজ করানোর পর আমার avenger আবার চলতে শুরু করল। বুক থেকে পাথর নামলো যেন…. ভাবলাম এই যাত্রায় বেঁচেই গেছি, কিন্তু মা দুর্গা অন্য কিছুই লিখেছিলেন কপালে।

যাইহোক, ঝাড়গ্রামে বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে খাওয়া দাওয়া করে বেরোবো বলে তৈরি। অমনি কোথা থেকে এক দল কালো মেঘ এসে আকাশ ঢেকেছে, বৃষ্টি নামল বলে। অপেক্ষা না করে বর্ষাতি পরে রওনা দিলাম। বড়োজোর ১০ মিনিট গাড়ি চালিয়েছি, অমনি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি রে ভাই…. সব ভাসিয়ে নিয়ে যায় আর কি। পথের ধারের এক দোকানে আশ্রয় নিলাম, বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। অবশেষে আকাশ একটু পরিষ্কার হতেই আবার যাত্রা শুরু। এরপর আর বিশেষ কোনও অসুবিধেয় পড়তে হয়নি। রহস্যময় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে জগরের মতো রাস্তা চলেছে…. পাহাড়ি চড়াই উতরাই পথে গাড়ি চালিয়ে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। অবশেষে রাত ৮টায় পৌঁছলাম যাযাবরী ইকো অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পে। রাতটা ঘুমিয়েই কাটল।

পরদিন অষ্টমীর সকালে লুচি আলুর দম আর চা সহ জলখাবার শেষ করে চললাম পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে। বামনি ফলস, মার্বেল লেক, হিল টপ সব দেখে যখন আপার ড্যামে পৌঁছোলাম, কপালটা আবার পুড়লো। আমার avenger আবার হাত তুলে দিয়েছে। অগত্যা এক মেকানিক ডাকা হল যে আমার বাইক ২ ঘন্টা ধরে নাড়াচাড়া করেও ধরতে পারল না রোগটা কী। এবার শুরু হল আমার শারীরিক আর মানসিক ক্ষমতার পরীক্ষা। ডাউনহিলে বাইক ঠেলে নামতে নামতে যখন নিচে এলাম, তখন আমাদের তিনজনের কারোর মধ্যেই আর কোনও শক্তি বেঁচে নেই। কাছের একটা মুদিখানা দোকান দেখে একটা দড়ি পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করছিলাম আমার গাড়িটা বন্ধুর গাড়িতে বেঁধে টেনে নিয়ে যাব বলে। দোকানের লোকটি কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই একজন মানুষের খোঁজ দিলেন। বললেন, সামনের ওই চা দোকানে যাও, ওখানে গেলে তোমার গাড়ির কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। আমাদের চিন্তা ভাবনার শক্তি লোপ পেয়েছিল, অগত্যা গেলাম সেই দোকানে।

এখানেই আমাদের প্রথম পরিচয় ভোটা দার সঙ্গে। যিনি এক উদ্ধারকারী রূপে এন্ট্রি নিলেন। গ্রামের মানুষ সত্যিই কত সহজ সরল হন আর কারও বিপদে প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, আবারও সেটা চোখের সামনে দেখলাম। ভোটাদা আর তার আরও ৪–‌৫ জন্য সাঙ্গ পাঙ্গ জুটে গেল আমার গাড়িটা মেরামত করতে। সবাই বলল, ‘‌আপনারা রিসর্টে ফিরে যান, স্নান খাওয়া দাওয়া করুন, সকাল থেকে কিছু খাননি, আমরা দেখছি, ঠিক হলেই খবর দেব।’‌

আশায় বুক বেঁধে আমরা রিসর্টে ফিরলাম। স্নান খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, অমনি ফোনের রিং বেজে উঠল। ভোটাদা কল করেছেন, বললেন ‘‌দাদা, আপনার গাড়ি স্টার্ট হয়েছে। এসে নিয়ে যান’‌। উফঃ বুক থেকে যেন পাথর নামল। সন্ধেবেলা গেলাম গাড়ি আনতে। সবাই কত খুশি, আমি জাস্ট ভাবছি শহরের মানুষও যদি এতটা হেল্পফুল হতো। একজন অচেনা অজানা মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে এরা কত আনন্দ পাচ্ছে। যাইহোক ভোটাদা দের অনেক ধন্যবাদ দিয়ে গাড়ি নিয়ে রিসর্টে ফিরলাম। নিশ্চিন্ত হলাম যে কাল গাড়িটা নিয়ে কলকাতা ফিরতে পারব। রাতে ছৌ নাচের আসর বসল। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম সবাই, তারপর খাওয়া দাওয়া করে এক্কেবারে সোজা বিছানায়। সারাদিন যা ধকল গেছে!‌ ঘুম আসতে সময় লাগল না। কিন্তু তখনো বুঝিনি আমার কপালে পরের দিন আরও বড় কিছু লেখা আছে।

পরদিন সকালে উঠে তৈরি হয়ে ফেরার পথ ধরলাম। বড়োজোর ১ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়েছি। আবার আমার avenger দিল হাতটি তুলে, সে আর এগোবে না। উপায় না দেখে আবার ভোটাদার শরণাপন্ন হতে হল। আর অবাক হওয়ার বিষয় যে উনি ৫ মিনিটের মধ্যে হাজির। সবকিছু দেখে বললেন, ‘‌দাদা, সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, গাড়ির রেগুলেটার খারাপ হয়েছে। সময় লাগবে। কারণ, বাঘমুন্ডি বাজারে বাজাজের পার্টস পাওয়া যায় না।’‌ জিজ্ঞেস করলাম উপায় কী? উনি বললেন, ‘‌পুরুলিয়া টাউন থেকে পার্টস আনতে হবে, দেখছি কী করা যায়।’‌ এরপর আমরা ওনার হাতে সব ছেড়ে দিয়ে শুধু বসে রইলাম। উনি ওনার যত কন্টাক্ট আছে সবাইকে একের পর এক ফোন করলেন। অবশেষে লোকজন জোগাড়ও করলেন। ওনার জানা শোনা একজন পুরুলিয়াতে পার্টস কিনলেন তারপর একটা স্টেট বাসের ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়ে দিলেন। এই সমস্ত ঘটনার মাঝে কখন সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে খেয়াল ছিল না। কিন্ত ভোটাদা একবারও আমাদের ছেড়ে কোথাও গেলেন না। বললেন, ‘‌দাদা পার্টস আসতে সময় লাগবে, সন্ধে হয়ে যাবে, আজকে আর ফিরে কাজ নেই, আজ এখানেই কোনও গেস্ট হাউসে থেকে যান।’‌

অগত্যা রাজি হতে হল। তারপর উনি আমাদের একটা ভাল হোটোলে লাঞ্চ করালেন, ভাল একটা গেস্ট হাউস সস্তায় বুক করে দিয়ে তারপর বাড়ি গেলেন। বলে গেলেন পার্টস এলে জানাবেন। পাটর্স পেতে রাত হল, প্রায় ৮টা। তখন সব দোকান পাঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভোটাদা ফোন করে বললেন, ‘‌চিন্তা করবেন না, কাল সকালেই আপনার কাজটা করে দেব, নিশ্চিন্তে ঘুমোন।’‌ পরের দিন সক্কাল সক্কাল ভোটাদা এসে হাজির। আমাদেরকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন, চা খাওয়ালেন, তারপর চলে গেলেন দোকানে। বলে গেলেন, ‘‌আপনারা তৈরি হন, আমি দোকানে গিয়ে কাজটা করে দিই।’‌ আমরা তৈরি হতে হতে উনি গাড়ির কাজ করে হোটেলে নিয়ে চলেও এলেন।

বেরোনোর আগে ভোটাদা কে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা সার্ভিস চার্জ কত দেব? উনি তো কিছুতেই বলবেন না, বার বার বলছেন, ‘‌আপনাদের যা মনে হয় দিন।’‌ উনি আমাদের জন্য যা করলেন তার সত্যিই কোনও দাম হয়না। শেষে ওনাকে যা দিলাম তাতে উনি খুশিই হলেন মনে হল। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে বললেন, ‘‌দাদা, আবার আসবেন, এলে দেখা করবেন, বাড়ি পৌঁছে খবর দেবেন।’‌

এই হচ্ছে ভোটাদার গল্প, ভোটাদাদের গল্প, যাঁরা আজও মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ান। ক্ষমা করবেন, দুশ্চিন্তায় আর অনিশ্চয়তার মাঝে ভোটাদার কোনও ছবি তুলতে পারিনি।‌‌

 

(বেড়াতে গিয়ে আমরা এমন অনেক মানুষের সন্ধান পাই, যাঁরা মনের মধ্যে একটা ছাপ ফেলে যান। পথের পরিচয় আর পথের থাকে না। তেমন মানুষদের কথা মাঝে মাঝেই উঠে আসে বেঙ্গল টাইমসে। এমন মানুষদের নিয়ে আপনিও আপনার অভিজ্ঞতা মেলে ধরতে পারেন। পাঠিয়ে দিন বেঙ্গল টাইমসের ঠিকানায়। লেখা পাঠানোর ঠিকানা:‌ bengaltimes.in@gmail.com)

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.