তোর্সা চ্যাটার্জি
কোনও ঐতিহাসিক শহর, যত নিরিবিলি হয় ততই ভালো।
ধরুন দিল্লি বেড়াতে গেছেন। কাবুলি দরওয়াজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবার চেষ্টা করছেন, এই জায়গাতেই বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্রদের খুন করা হয়েছিল, এমন সময় পিছন থেকে মোটর গাড়ি উচ্চকিত হর্ন বাজাতে শুরু করল। লালকেল্লায় ঢুকছেন। ভাবছেন, এই পথ দিয়ে এক দিন সাজাহান… অমনি সুভেনির শপের বিক্রেতার চেঁচামেচিতে ধ্যান ভেঙ্গে গেল।
যদি ঐতিহাসিক জায়গায় বেড়াতে ভালবাসেন আর এই সব সমস্যায় বার বার বিরক্ত হন, তাহলে চলুন খাজুরাহো থেকে ঘুরে আসি। এই জায়গাটার নাম ডাক জগৎজোড়া হলেও তেমন জমজমাট নয়। বড় বড় বাড়ি নেই, শপিং মল নেই, বেশ একটা শহরতলির মত ছিমছাম ভাব আছে। গ্যাঞ্জাম যা আছে, তা মন্দির চত্বরের আশপাশে। দু হাত ছাড়া ছাড়া হোটেল।
যদি সেটুকুও এড়াতে চান, তাহলে মন্দির থেকে একটু দূরে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের হোটেল পায়েলে মাথাগোঁজার ব্যবস্থা করুন। শান্ত শহরের মতই শান্ত নিরিবিলি একতলা হোটেল। সামনে সবুজ ঘাসের লন-বাগান, পিছনে সারি সারি পলাশ গাছ, মাথার ওপরে ধনেশ পাখির ওড়াউড়ি। অথচ সুবিধা আছে সব রকমের। সুইমিং পুলও আছে। আর আছে অনেকগুলো সাইকেল। কেন? যদি আমার পরামর্শ শোনেন, তাহলে বলব, খাজুরাহো শহরটাকে ঘুরে দেখার জন্য চারচাকার গাড়ি নয়, একটা সাইকেল ভাড়া করুন। মোটামুটি চালাতে পারলেই হবে। রাস্তা খুব ভালো আর গাড়ির সংখ্যা কম। দুর্ঘটনার ভয় নেই বললেই চলে।
সাইকেল চালিয়ে প্রথমেই চলে যান ওয়েস্টার্ন গ্রুপ অফ টেম্পলে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্গত এই মন্দিরগুলোই খাজুরাহোর মুল আকর্ষণ। মন্দির চত্বরে ঢুকে গেলে বাইরের হোটেলগুলো আর চোখে পড়ে না। লোকজনও বেশি নেই। আসলে বেশিরভাগ পর্যটক খাজুরাহোতে আসেন আদিরসাত্মক মূর্তি দেখতে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, খাজুরাহোর মন্দিরগাত্রে যত মূর্তি আছে তার মধ্যে আদিরসাত্মক মূর্তি বড়জোর এক পঞ্চমাংশ। নগ্নতা অবশ্যই আছে, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই নগ্নতা আর অশ্লীলতাকে গুলিয়ে ফেলেন না?
আদিরস দেখার সাধ মিটে গেলেই দেশি পর্যটকরা মন্দির ছাড়েন। বরং আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকেন বিদেশিরা। আপনিও দেখুন, লক্ষ্মণ, চিত্রগুপ্ত, কান্দারিয়া মহাদেব, বিশ্বনাথ একের পর এক মন্দির। মূর্তিগুলির দিকে ভালো করে দেখুন, ভাবুন পাথরের শরীর এত কোমল হয় কোন জাদুতে? রক্তমাংসের শরীরেও বোধ করি এত পেলবতা থাকে না। বারবার দেখুন। প্রথমে গাইডের সাহায্য নিন, তারপর নিজের মতো করে দেখুন। তবে দোহাই মূর্তিগুলোর গায়ে হাত দেবেন না। বারবার হাত বুলানোর ফলে মূর্তিগুলো দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
দেখে দেখে যখন আশ মিটবে (যদি আদৌ মেটে), তখন রওনা দিন ইস্টার্ন গ্রুপ অফ টেম্পলের দিকে। এবার গ্রামের পথ। পদ্মদীঘির ধারে ব্রহ্মা মন্দির, ঘুঁটে দেওয়া দেওয়ালের কাছে জাভরি মন্দির, বামন মন্দিরের পাশের জলাশয়ে মোষ চান করছে। ইস্টার্ন গ্রুপের আসল আকর্ষণ জৈন মন্দিরগুলি। এর মধ্যে কয়েকটি মন্দিরে এখনও পুজা হয়। আর কার বুদ্ধিতে জানি না, এই সব মন্দিরের তথাকথিত অশ্লীল মূর্তিগুলোকে প্লাস্টার করে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এসে কি করবেন তা নিয়ে অবশ্য একটু সমস্যা আছে। যাকে বলে উভয়সঙ্কট। এই সময়ে একদিকে ওয়েস্টার্ন গ্রুপ অফ টেম্পলে হয় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। অন্য দিকে একটি অডিটোরিয়ামে বসে মধ্যপ্রদেশের লোকনৃত্যের আসর। আপনি কোনটা দেখবেন সে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। যেটাই দেখুন, রাতে হোটেল পায়েলে পেট পুরে খাওয়ার পর, সামনের লনে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে মনে হবে, ইস অন্যটা বাকি রয়ে গেল!
তাহলে কী করবেন? এর সহজ সমাধান হল, পরদিন সকালে আবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। গতকাল যে মন্দিরগুলো ভালো করে দেখা হয়নি, সেগুলো আবার দেখুন। এখনও তো সাদার্ন গ্রুপের মন্দিরগুলো দেখা হয়নি। এক দিনেই খাজুরাহো দেখা শেষ করে ফেলবেন? আপনি কি এতটাই বেরসিক নাকি?