উত্তম জানা
বছর সাত আগের কথা। সেবার লোকসভায় দুটি আসন পেয়েছিল বামেরা। বিজেপিও পেয়েছিল দুটি আসন। আর ভোটের শতাংশের হিসেব! বাম যেখানে তিরিশ শতাংশ, সেখানে বিজেপির ভোট ছিল সতেরো শতাংশ। আবার আট শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেসের আসন ছিল চার।
দ্বিতীয় শক্তি আসলে কে? আসনের বিচারে কংগ্রেস, শতাংশের বিচারে বাম। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতে ছবিটা কেমন যেন উল্টে গেল। ১৭ শতাংশ পাওয়া বিজেপি দ্রুত উঠে আসতে লাগল দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে। বিভিন্ন উপনির্বাচনে তখন বিজেপি দ্বিতীয় হচ্ছে। একে একে অনেকেই বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। কেউ তৃণমূল ছাড়ছেন, কেউ বাম শিবির ছাড়ছেন। তার চেয়েও বেশি আসছেন বিনোদন জগতের লোকেরা। আর মিডিয়ার লাগাতার প্রচার তো ছিলই। তখন জোর জল্পনা, মুকুল রায় বিজেপিতে আসছেন। শুভেন্দুর নামের জল্পনাটাও সেই তখন থেকেই। সবাই তখন ধরেই নিয়েছেন, বিধানসভায় দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসছে বিজেপি।
কিন্তু ২০১৫ পুরভোটের পর থেকেই ছবিটা একটু একটু করে পাল্টাতে শুরু করল। ২০১৬ বিধানসভা ভোটের আগেই পরিষ্কার হয়ে গেল, বিজেপির সেই হাওয়া অনেকটাই স্তিমিত। তারা সরকার গড়া তো দূরের কথা, দ্বিতীয় স্থান থেকেও বহুদূরে থাকবে। ঠিক সেটাই হল। আসন পেল মাত্র তিনটি। তার থেকেও বড় কথা, অধিকাংশ আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত। পাঁচটি আসনেও দ্বিতীয় হতে পারল না। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই আবার উলট পুরান। ৪৪ আসন পাওয়া কংগ্রেস বা ৩৪ আসন পাওয়া বাম নয়। যাবতীয় প্রচারের ঢক্কানিনাদ সেই ৩ আসন পাওয়া বিজেপিকে নিয়ে। তারাই যেন দ্বিতীয় শক্তি। লোকসভার আগে ভোটের অদ্ভুত এক মেরুকরণ। লড়াইটা যেন তৃণমূল আর বিজেপির। আর কোনও শক্তি যে নির্বাচনের ময়দানে আছে, তা টিভি দেখলে বা কাগজ পড়লে মনেই হত না। লোকসভায় কংগ্রেস দুটি আসন পেলেও বামেদের খাতা সেই শূন্য। দু’বছর পর জোট করেও ফল হল না। এবার বাম, কংগ্রেস দুজনেই শূন্য।
সেবার হাওয়া ঘুরেছিল পুরভোট থেকে। এবারও কি তেমনই ইঙ্গিত? আসন সংখ্যার বিচারে তৃণমূলের পর অবশ্যই বিজেপি। তাদের আসন তিনটি। বাম আর কংগ্রেস দুটি করে। কিন্তু শতাংশের হিসেবে বিজেপিকে ছাপিয়ে উঠে এসেছে বামেরা। তার থেকেও বড় কথা, ৬৬ আসনে দ্বিতীয় স্থানে বামেরা। সেই নিরিখে অনেকটা পিছিয়ে বিজেপি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বামেরা যদি সব আসনে প্রার্থী দিত, এবং মোটের ওপর পরিচ্ছন্ন নির্বাচন হত, তাহলে আরও কয়েকটি আসন যেমন বামেদের দখলে আসতে পারত, তেমনি আরও অন্তত দশটি জায়গায় বামেরা দ্বিতীয় হতে পারত, ভোটের শতাংশ হারও নিশ্চিতভাবেই বাড়ত। অর্থাৎ, তৃণমূল বিরোধী ভোটের অভিমুখটা আবার কিছুটা হলেও বামের দিকে ঘুরছে। ১১ শতাংশ ভোট পাওয়া মানে বিরাট সাফল্য বলা যায় না। তা নিয়ে বিরাট মাতামাতিরও কিছু নেই। কিন্তু একটু হলেও বিজেপি শিবির থেকে হাওয়া ঘুরে বামেদের দিকে আসছে, এটা কিন্তু কম ব্যাপার নয়। এটাই এবারের পুর নির্বাচনের সবথেকে বড় তাৎপর্য।
অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন, বিজেপি বোধ হয় সাংগঠনিকভাবে দারুণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তাই তারা বিধানসভায় ৭৭ আসন পেয়েছিল। এমন অনেক আসন আছে, যেখানে বিজেপি বিরাট ব্যবধানে জয় পেয়েছে, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে বামেদের থেকে অনেক পিছিয়ে। মোদ্দা কথা হল, একটা বিরাট অংশের মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন, তৃণমূলকে কেউ ঠেকাতে পারলে বিজেপিই পারবে। এই বিশ্বাসে ভর করেই বিজেপি এত মানুষের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে অনেকেরই মোহভঙ্গ হয়েছে। বুঝেছেন, তৃণমূলের লোক ভাঙিয়ে তাদের টিকিট দিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যাবে না। যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে গেছেন। আরও কেউ কেউ যে কোনওদিনই ফিরতে পারেন। দিল্লির নেতারা মুখে যাই বলুন, সারদা বা নারদার তদন্ত মাঝে মাঝেই কেন শীতঘুমে চলে যায়, কয়লাকাণ্ড কেন হিমঘরে চলে যায়, সেটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতিতে তরুণ বাম কর্মীদের ভূমিকাও মনে রাখার মতোই। জীবন বিপন্ন করেও অক্সিজেন সিলিন্ডার, ওষুধ নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গিয়েছেন রেড ভলান্টিয়াররা। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অনেক উজ্জ্বল মুখকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন বাম নেতৃত্ব। বিধানসভা ভোটে হয়ত তার সুফল পাওয়া যায়নি। একঝাঁক উজ্জ্বল মুখকে হারতে হয়েছিল। কিন্তু মানুষের মনে কোথাও একটা ছাপ ফেলেছিল এই তরুণ ব্রিগেড। পুরসভাতেও সেই তরুণ ব্রিগেডেই বড় ভরসা রেখেছিলেন বাম নেতৃত্ব। যাঁরা জিতলেন, তাঁরা হয়ত অভিজ্ঞ, প্রবীণ। কিন্তু সমানে সমানে টক্কর দিয়ে গেলেন তরুণরা। আসন সংখ্যার নিরিখে হয়ত ফারাকটা অনেক। কিন্তু কয়েকমাস আগের বিধানসভা নির্বাচনে যে বামেরা পাঁচটি আসনেও বিরোধী ছিল না, তাঁদের ৬৬ আসনে বিরোধী হিসেবে উঠে আসাটা বেশ ইঙ্গিতবাহী।
যে যাই বলুন, ভোটের আসল চালিকাশক্তি হাওয়া। সেই হাওয়া নির্মাণের ক্ষেত্রে মিডিয়ার যেমন একটা ভূমিকা থাকে, দলীয় কর্মী সমর্থকদেরও একটা বড় ভূমিকা থাকে। মিডিয়া কেন দেখাল না, এই আক্ষেপ করলে সমাধানের রাস্তা বেরোবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি সাঁটিয়ে গেলেও বিরাট ইতিবাচক ফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আসল কথা, নিজেদের ধারাবাহিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। বড় বড় ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ছেড়ে পাড়ার ছোট ছোট সমস্যায় মানুষের পাশে থাকা। মনে রাখতে হবে, এখন দ্বিতীয় হওয়াটাই বেশি জরুরি। হাওয়া ঘুরছে। পুরভোট কিন্তু সেই বার্তাই দিয়ে গেল। এবার অন্যান্য পুরনিগম আর জেলায় জেলায় পুর ভোটে কোন ফল উঠে আসে, সেটাই দেখার।