আমাদের অনেকের ছোটবেলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নাম- বুড়িমার চকলেট বোম। কে ছিলেন এই ‘বুড়িমা’। কীভাবে গড়ে উঠল তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য? লড়াকু সেই বুড়িমার জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত তুলে ধরলেন সংহিতা বারুই।
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি বুড়িমার কথা। বাড়ির লোকের কাছে জানতে চাইতাম, কে এই বুড়িমা ? তিনি কোথায় থাকেন? কোনও উত্তর পেতাম না। পুজো এলে প্রশ্নটা ফিরে ফিরে আসত। পুজো পেরিয়ে গেলে প্রশ্নটাও থেমে যেত। আবার পুজো আসত। আবার ভেসে উঠত প্রশ্নটা। এভাবেই আমাদের অনেকের বেড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘বুড়িমার চকলেট বোম’।
বড় হলাম। কিন্তু ছেলেবেলার সেই প্রশ্নটা মাথায় থেকেই গিয়েছিল। কে এই ‘বুড়িমা’? তিনি কোথায় থাকেন? খোঁজ করতে করতে চলেই গেলাম। জানলাম, এক লড়াকু মহিলার দুরন্ত লড়াইয়ের উপাখ্যান। নিছক গল্প বলা ঠাকুমা নন। তাঁর লড়াই অনেকটা রূপকথার মতোই। পুজোর আবহে প্রিয় পাঠকদের কাছে তুলে ধরা যাক সেই লড়াইয়ের উপাখ্যান।
তার আগে বুড়িমার আসল নামটা বলে ফেলা যাক। তাঁর আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস। জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতার যে কঠিন লড়াই, তা খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। ফরিদপুর থেকে পশ্চিম দিনাজপুরের ধলদিঘি সরকারি ক্যাম্পে ছিন্ন মূল হয়ে আসা। তারপর ধলদীঘি থেকে হাওড়ার বেলুড়ে আসা। অনেক দুঃখ, অনেক যন্ত্রণা ,অনেক হাহাকার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। তবু তিনি সাধারণ বাঙালি নারী হয়েও ব্যবসা ক্ষেত্রে একা সাফল্যের ধ্বজা তুলে ধরেছিলেন। অন্নপূর্ণা দাস থেকে পরিণত হলেন অবশেষে বুড়িমা তে ।
সালটা ১৯৪৭। ভারতের স্বাধীনতার বছর। কিন্তু এখন যেটা বাংলাদেশ, তখনকার পূর্ব পাকিস্তান, সেখানের অবস্থা নারকীয়। লুঠতরাজ, হত্যা, ধর্ষণে জর্জরিত। সেই সঙ্গে চলছে জবরদখল। দলে দলে মানুষ তখন ভারতমুখী। চার সন্তানের জননী অন্নপূর্ণা এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা। তিন মেয়ে এক ছেলে। বড় আর মেজ মেয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছে। ছোটো ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে যে এপার বাংলায় চলে আসবেন, সে উপায়ও নেই। স্বামী সুরেন্দ্রনাথের তেমন সায় ছিল না। তাঁর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েছিলেন অন্নপূর্ণাও। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৪৮ নাগাদ আশপাশের আর দশটা পরিবারের মতো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসালেন অন্নপূর্ণাও।
ভারত অভিমুখে যাত্রা। পশ্চিম দিনাজ পুরের ধলগিরি ক্যাম্প। সঙ্গে ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে। সুখের সংসার থেকে একেবারে রিফিউজি ক্যাম্পে। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। রোজ ভোরে উঠে সন্তানদের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম। কোনও দিন পটল, বেগুন, কুমড়ো , ঝিঙে কিনে বাজারে বিক্রি করা। কখনও বা কর্মকারের কাছ থেকে হাতা, খুন্তি কিনে হাটে বিক্রি কিংবা বাড়ি বাড়ি নানান সামগ্রী ফেরি। এই ভাবেই চলছিল। গঙ্গারামপুরে এভাবেই একদিন পরিচয় হয়ে গেল সনাতন মণ্ডলের সঙ্গে। তাঁর মুদির দোকান তো ছিলই, তার সঙ্গে তিনি দক্ষ হাতে বিড়িও বাঁধতে পারতেন। অন্নপূর্ণা দেবীকে তিনি মা বলে সম্বোধন করেছিলেন নিজের হারানো মা কে ভুলতে। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠার পর অন্নপূর্ণাদেবী সনাতনের কাছে জানতে চাইলেন বিড়ি বাঁধার কায়দা। মাতৃসমা অন্নপূর্ণা দেবীকে খুব যত্ন করেই বিড়ি বাঁধা শেখালেন সনাতন। ক্রমে ক্রমে অন্নপূর্ণাও হয়ে উঠলেন বিড়ি বাঁধায় দক্ষ। শুধু তাই নয়, বছর তিনেক ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি খুলে ফেললেন একটা বিড়ি তৈরির কারখানা। সেই সঙ্গে গড়ে উঠল একটা নিজের পাকা বাসস্থানও।
তবে সমস্ত সুখ একসঙ্গে হয় না। তাই তালেগোলে একমাত্র ছেলের লেখাপড়াটাই শিকেয় উঠল। তার সঙ্গে আরও একটা বিপর্যয়। অন্নপূর্ণার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে পড়তে লাগল সনাতনের ব্যবসা। তিনি গঙ্গারামপুর থেকে চাটিবাটি গুটিয়ে চলে গেলেন শ্বশুরবাড়ি শিলিগুড়িতে। যাওয়ার আগে তিনি অন্নপূর্ণাদেবীর ছোট মেয়ের জন্য একটা পাত্রও ঠিক করে দিয়ে গেলেন। পাত্র বেলুড়ের। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে জামাই বেলুড়ের প্যারীমোহন মুখার্জি স্ট্রীটে একটা দোকান–সহ বাড়ির সন্ধান দিলেন। দাম মাত্র ন’শো টাকা। আস্তে আস্তে অন্নপূর্ণা দেবী পরিচিত হলেন কলকাতার ব্যাপারী জগতের পীঠস্থান বড়বাজারে সঙ্গে। বিড়ির সঙ্গে চলতে লাগল নানা ধরনের ছোটখাটো জিনিসের ব্যবসা। এখানেও সনাতনের মতো পেয়ে গেলেন হরকুসুম গাঙ্গুলিকে। কিন্তু ব্রাহ্মণ সন্তান হওয়ায় তাঁকে সনাতনের মতো সহজে ছেলে বলে মেনে নিতে দ্বিধায় ছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। তবে বিভেদ ঘুচিয়ে দিলেন হরকুসুমই। একদিন অন্নপূর্ণা দেবীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে স্বীকার করিয়ে নিলেন ছেলে হিসেবে। এঁর কাছ থেকেও অন্নপূর্ণা দেবী শিখে নিলেন আলতা, সিঁদুর বানানোর কৌশল। কুশলী অন্নপূর্ণা কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন আলতা -সিঁদুরে।
আসলে অন্নপূর্ণা দেবী যে ব্যবসাই করুন না কেন, তিনি সেটা করতেন বেশ যত্ন নিয়ে। তাই কৃত কর্মের ফল পেতে তাঁর বিশেষ বেগ পেতে হত না। তিনি নানান মরশুমে মরশুমের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ঘুড়ির সময় ঘুড়ি, দোলের সময় রঙ, স্বরস্বতী পুজোর সময় ঠাকুর, এমনকী কালী পুজোর সময় অন্যের থেকে কিনে এনে বাজিও বিক্রি করতেন ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনার জন্য। এমনি করেই এসে গেল পরের পুজো। বাজি বিক্রি করতে করতে আবিষ্কার করলেন কমবয়সীরা তাঁকে বুড়িমা বলে সম্বোধন করছে। দিনের শেষে অবাক অন্নপূর্ণা। নিজেকে আয়নায় দেখে আবিষ্কার করলেন জীবনের নানান ওঠা পড়ার মাঝে কখন যেন তাঁর মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি হয়ে গিয়েছেন ‘বুড়িমা’। তা বুড়ির দমে যাওয়ার বদলে এল নতুন উদ্যম। হোক না সাদা চুল। কুছ পরোয়া নেই। আরও বেশি বেশি করে বাজি কিনে এনে দোকান ভরানোর উৎসাহ এসে গেল তাঁর মাথায়। কিন্তু টাকা কোথায়? অগত্যা হা পিত্যেশ করে বসে বসে ভাবনা। ভাবনার কারণ জানতে পেরে সাহ্যয্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন নমিতা দেবী। একহাজার টাকা ধার নিয়ে বড়বাজার থেকে বাজি এনে ভরিয়ে তুললেন দোকান বুড়িমা। এটা দেখি, বুড়িমা ওটা দেখি, কচিকাচাদের কিচিরমিচিরে মন ভরে গেল অন্নপূর্ণার। কিন্তু এবারে বিধি বাম। পুলিশ এসে জানতে চাইল বাজি বিক্রির সরকারি ছাড়পত্র তাঁর কাছে আছে কি না। তা না থাকায় সমস্ত বাজি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে চলে গেল তারা।
সারা জীবন ধরে সংগ্রামী জীবন–যাপন করা বুড়িমা অত সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নন। তাঁরও জেদ চেপে গেল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন শুধু বাজি বিক্রিই নয়, বাজি তৈরিও করবেন। আর তার জন্য যাবতীয় ছাড়পত্র তিনি জোগাড় করে ফেললেন। ছেলে তো মায়ের কাণ্ড কারখানা দেখে অবাক। কিন্তু বুড়িমা এক মরশুমেই বাজি তৈরির কাঁচামাল, তা বানানোর পদ্ধতি প্রভৃতি জানার জন্য হাওড়ার বাঁকরা, বজবজের নুঙ্গি চষে ফেললেন। যখনই তিনি নতুন নতুন ব্যবসায় হাত দিয়েছেন, তখনই তাঁর সামনে দেবদূতের মতো হাজির হয়েছেন কখনও সনাতন, কখনও হরকুসুম , কখনও বা নমিতা । এবারেও বাজি বিশারদ আকবর আলির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটল। নিজের হাতে শিখে নিলেন বাজি তৈরির হরেকরকম পন্থা। তারপরই তাঁর এক মাত্র ধ্যান-জ্ঞান হল বাজি তৈরি।
কিন্তু সেই বাজির তো কিছু একটা নাম রাখতে হবে। নিজের পরিচয়েই তৈরি হল বাজির ব্র্যান্ড। নাম দেওয়া হল ‘বুড়িমা’। ওই নামেই তিনি কচিকাচাদের কাছে পরিচিত। সেই থেকেই শুরু হল ‘বুড়িমা’র জয়যাত্রা। একে একে তিনি রপ্ত হতে থাকলেন সোরা, গন্ধক, বারুদের বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণ ছেকে কীভাবে নানা রকমের বাজি তৈরি করা যায়। তবে হরেক কিসিমের বাজি বানালেও রাতারাতি তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন যেটা বানিয়ে, তা হল বুড়িমার চকলেট বোম। টালা থেকে টালিগঞ্জ, হাওড়া থেকে বারাসত সব জায়গাতেই বিখ্যাত হয়ে উঠল এই নাম। এক মরশুম থেকে আর এক মরশুমের মাঝে ব্যবসাকে কী করে আরও বাড়ানো যায় সেই চিন্তাতেই কাটত বুড়িমার দিন।
এর ফাঁকেই তিনি তালবান্দা আর ডানকুনিতে তৈরি করে ফেললেন আরও দুটো কারখানা । ছেলে সুধীরনাথকে কুঁড়েমি কাটানোর জন্য রবার ফ্যাক্টরিতে কাজে লাগিয়েছিলেন। এবার ওই কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে বসালেন কারখানায়। নিজে আরও বড়, আরও বড় কারখানা, আরও বড় ব্রাণ্ডিং – এর প্রয়োজনে পাড়ি দিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত বাজি শহর শিবকাশীতে। সেখানেই লিজে জমি নিয়ে একটা কারখানা গড়ে তৈরি শুরু করলেন দেশলাই। রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে এবার বুড়িমার নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতবর্ষে। ইতি মধ্যে সুরদের কাছ থেকে পিয়ারি মোহন স্ট্রিটে জোগাড় করলেন আরও জমি। এখানে নিজেদের আবাসস্থল তুলে আনার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে তুললেন একটা বড় গুদামঘরও। ভাগ্যের এমনই নিষ্ঠুর পরিহাস, বুড়িমা ১৯৯৫ সালে দেহত্যাগ করার পরই ১৯৯৬ সাল থেকে কিছু বছর শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যদিও ইতি মধ্যে শব্দ বাজির ঊর্ধ্বসীমা ৯০ ডেসিবেলের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ওই শব্দ মাত্রার ওপরের বাজি ওখানে বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয়। বাজি ফাটানো যাবে কিনা, তা নিয়ে মাঝে মাঝেই আদালতে মামলা হয়। জল গড়ায় হাইকোর্ট, এমনকী সুপ্রিম কোর্টেও। কিন্তু বাজিকে ঘিরে নস্টালজিয়া। সেখানে তো আর কোর্টের হাত নেই। শুধু চকলেট বোম নয়, তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরও নানা ধরনের বাজিরই বিপণন এখনও হয়ে চলেছে। আর তা করে চলেছেন তাঁর দুই সুযোগ্য নাতি সুমন আর রমেন দাস। তাঁরা জানালেন, বিনা শব্দের বাজির মধ্যে তাঁরা এনেছেন বিভিন্ন বৈচিত্র্য। এসব প্ল্যান প্রোগ্রাম হচ্ছে একেবারে নতুন প্রজন্মের মানুষ সুমন দাসের ছেলে সদ্য এম বি এ পাশ করা সুমিত দাসের নেতৃত্বে। না থেকেও আছেন বুড়িমা। আছে দুরন্ত সেই লড়াইয়ের রূপকথা।