সরস্বতী মানে কি শুধুই মেয়েদের শাড়ি পরা আর ছেলেদের মেয়ে দেখা? তার বাইরেও আরও অনেককিছু। পরের দিন অরন্ধন। যৌথ পরিবারে সে যেন এক মহারন্ধনের কর্মযজ্ঞ। ফেলে আসা সময়ে উকি দিয়ে টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলো ফিরে দেখা। লিখলেন অন্তরা চৌধুরি।
আজ অরন্ধন। ছোটবেলা থেকেই এই ‘উৎসব’ আমাদের বাড়িতে দেখে আসছি। ‘উৎসব’ বললাম, কারণ কালীপুজো, দুর্গাপুজোর সঙ্গে এর জৌলুস কোনও অংশে কম নয়। বরং বেশ কিছুটা বেশিই। সরস্বতী পুজোর একটা উত্তেজনা তো থাকতই। তার থেকে বেশি উত্তেজনা ছিল সারাদিন ধরে গোটা বাড়িটা হইহই করত। রাত্রি বারোটা পর্যন্ত চলত রান্না।
বিশাল বড় উনুনে ঠাকুমা একের পর এক রান্না করত। আলুভাজা, বেগুনভাজা, পালংশাক, বাঁধাকপি, মাছের ঝোল, মাছের ঝাল, মাছের টক, চাটনি এবং সবশেষে শুদ্ধ কাপড় পরে গোটাসেদ্ধ করা হত। ভাতের হাঁড়ির সাইজ না বলাই ভাল। মা, কাকিমা, জেঠিমারা সারাদিন ধরে রান্নার জোগাড় দিত। ছোটমা তো কুয়োতলাতেই বসে থাকত। আর সারাদিন ধরে শুধু মাছ ধুয়ে যেত। বাবা, কাকা, জেঠুদের মধ্যে রেশারেশি চলত। কে কত মাছ আনতে পারে। চোদ্দ পনের কেজি মাছ তো কোনও ব্যাপারই নয়। তাতেও তাদের মন ভরত না। বাড়িতে সব মিলিয়ে সদস্য সংখ্যা আঠার থেকে কুড়ি। দু একজনের আমন্ত্রণও থাকত।
মা, কাকীমাদের ঘাড় পিঠ টানত। বেচারারা সারাদিন খেটে সবে একটু জিরোতে বসেছে। অমনি রাত দশটার সময় বাবুকাকা আবার চার কেজি মাছ নিয়ে এসে হাজির। যদি কম পড়ে! আমার তিয়াত্তর বছরের ঠাকুমার রাত্রিবেলাতেও সে কি এনার্জি। সে ওই খোঁড়া পায়ে মোড়াতে বসে কাঠের উনুন ধরিয়ে আবার রান্না করতে শুরু করত। বাড়ির বউগুলো রাগে গজগজ করত। ঠাকুমা বলত-‘থাক। তোমাদের কিছু করতে হবে না। আমি রান্না করব’।
রাত্রিবেলায় শিল নোড়া ধুয়ে তাকে নতুন গামছা দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হত। তিনিই নাকি মা ষষ্ঠী। বাঁশ পাতা, দল ঘাস, শামুক সহ সিঁদুর, দই হলুদ আর কাজলের ফোঁটা দেওয়া হত মা ষষ্ঠীকে। ভোগ হিসেবে ভিজে ভাত, গোটা সেদ্ধ, আর যতরকম রান্না হয়েছে সবরকম সাজিয়ে দেওয়া হত। ধূপ, প্রদীপ, শঙ্খ আর হুলুধ্বনিতে পুজো করা হত। এবার বাড়ির সবাইকে সেই দই হলুদের ফোটা দিয়ে দেওয়া হত মা ষষ্ঠীর ভোগ। দেবতাদের মধ্যে এই মা ষষ্ঠী একটু ভিন্ন গোত্রের। কারণ ফল মিষ্টি এনার খুব একটা পছন্দ নয়।
অরন্ধনের দিন নাকি গরম কিছু খেতে নেই। তাই ঠাকুমা দেখতাম সকাল বেলায় চা, চিনি, জল রোদের মধ্যে রেখে দিত। রোদের আলোয় সেই চা গরম হত। তারপর খেত।
এখন অবশ্য যুগ পাল্টেছে। এখন আর কেউ এভাবে চা খায় না। তবে আমাদের বাড়িতে সেই ট্রাডিশন আজও বজায় আছে। কমে গেছে শুধু অস্বাভাবিক রকমের সদস্য সংখ্যা।
পড়াশোনা, বিয়ে এবং চাকরি সূত্রে বাড়ির ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কালের নিয়মে পরিবারের বেশ কিছু সদস্য আজ আর নেই। রয়ে গেছে স্মৃতি হয়ে। অতবড় বাড়িতে এখন জনাকয়েক লোকজন। তারা আজও বাঁচিয়ে রেখেছে সেই ফিকে হয়ে যাওয়া উৎসবের ইতিহাসকে। পনের কুড়ি কেজি মাছ এসে দাঁড়িয়েছে আট দশ কেজিতে।
এই উৎসব বাঁকুড়া পুরুলিয়াতে মাছের উৎসব। স্থানীয় নাম ‘সিজানো’। সারাবছর মাছ খেলেও এই বিশেষ দিনটির জন্য থাকে সকলের অপেক্ষা। আর আমরা যারা জীবনের প্রয়োজনীয়তায় আমাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে গেছি, আজকের স্মৃতিচারণ সেই ‘আমাদের’ উদ্দেশ্যেই।