‌সুন্দরবনের জলদস্যু

শুভেন্দু আচার্য

বাঙালির শীতের বেড়ানোর তালিকায় সুন্দরবন ভ্রমণের অন্তর্ভুক্তি অনেক আগে থেকে। আমার সুন্দরবন দেখা অনেকটা সে ভাবেই। মাধ্যমিকের পর মামা বললেন, ‘‌যাবি নাকি, সুন্দরবন দেখতে?’‌ ব্যস্, আমায় আর পায় কে? বাক্স–‌প্যাটরা গুছিয়ে, তিন দিন, দু’‌রাতের প্যাকেজ ট্যুরে চললাম। সঙ্গে মনাদি, জবা আর রাজা। সেই আমার প্রথম বন দেখা। দারুণ মজা হয়েছিল, তবে দু’‌রাত লঞ্চেই কাটিয়েছিলাম। আর, প্রথমবার বনের ধারে কোনও গ্রামে রাত কাটানো, বন্ধু তারাপদর সৌজন্যে। তারাপদ সর্দার, চাকদহ কামালপুর হাইস্কুলের সিনিয়র টিচার। ওর বিয়েতে অ্যানপুরে, ওর গ্রামের বাড়িতে সাত দিন ছিলাম। সেটাও প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। পেশাগত কারণে এরপর বহুবার সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি। কখনও পঞ্চায়েত নির্বাচন কভার করতে, কখনও বা কোনও প্রকল্প উদ্বোধনে মন্ত্রী–‌আমলাদের সঙ্গে, আয়লার পর, শেষবার গিয়েছি ক’দিন আগে, আমফানের পর। সবমিলিয়ে অভিজ্ঞতাও কম হয়নি।

তবে, সুন্দরবন ভ্রমণের সবথেকে রোমাঞ্চকর ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ২০০৭ সালে। সে কাহিনিই আজ তুলে ধরা যাক। সে সময় একটা বাংলা চ্যানেলের জন্য, আমরা একটু ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান করতাম। সপ্তাহে একদিন, একঘণ্টার শো। অল্প ক’‌দিনের মধ্যেই, বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল আমাদের অনুষ্ঠান। প্রোগ্রামটায় যাতে আরও ভাল কনটেন্ট দেওয়া যায়, আমরা সেই চেষ্টাই প্রতিনিয়ত করতাম। অনেক সময় সে কাজে ঝুঁকি ও ছিল। একবার ঠিক হল, সুন্দরবনের গ্রামে বাস করা মানুষগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর বিশদে একটা রিপোর্ট করব। অতনু রাহা তখন রাজ্যের মুখ্য বনপাল। তিনি এ বিষয়ে আমাদের সব রকমভাবে সাহায্য করলেন। আর ও একজনের কথা বলতেই হবে, তিনি কান্তি গাঙ্গুলি। সে সময় সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন। এই দু’‌জনের সহযোগিতায়, সে যাত্রায় কাজটা করা সম্ভব হয়েছিল।

jaladasyu4

এখন যেমন ক্যানিং থেকে ডকঘাট যেতে গেলে ব্রিজের উপর দিয়ে যাওয়া যায়, তখন কিন্তু মাতলা নদী পার হতে হত। ডকঘাট থেকে সড়ক পথে বাসন্তী হয়ে আমরা গোসাবা যাব। কিন্তু, আমরা ডকঘাটে পৌঁছে দেখলাম, রাস্তাঘাট জনশূন্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কোনও একটা আঞ্চলিক ইস্যুতে সেদিন ডকঘাট বন্‌ধ। আমাদের কাছে এই খবরটা ছিল না। তাই, লাগেজ, ট্রাইপড, ক্যামেরা ইত্যাদি লটবহর নিয়ে আমরা বেশ বিপাকেই পড়লাম। শেষে, নিজেদের পরিচয় দিয়ে, অনেক অনুনয়ের পর একজন রাজি হলেন। তাঁর বাইকে চেপে, তবে গোসাবা পৌঁছলাম। তারপর রাঙাবেলিয়া হয়ে সজনেখালির জেটিতে যখন পা রাখলাম, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে বনে। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। এখানে আকাশের তারাগুলো যেন অনেক বেশি উজ্জ্বল। এক ফালি চাঁদের স্বল্প আলোয়, আমরা ট্যুরিস্ট লজের রুমে ঢুকে পড়লাম।

সুন্দরবনে অনেকেই গেছেন। তাই, এই বন সম্পর্কে প্রায় সকলেই অবগত আছেন। তবু, কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি। বৃহত্তর সুন্দরবন, বিশ্বের সব থেকে বড় সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা মাটির ম্যানগ্রোভ অরণ্য। আয়তনে দশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি। দেশ ভাগের পর বাংলাদেশে এই বনের ৬০ শতাংশ আর আমাদের দেশে ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রায় চার হাজার বর্গ কিলোমিটার অংশ রয়েছে। বর্তমানে দঃ ও উঃ ২৪ পরগণা, এই দুই জেলায় বিস্তৃত একটি জাতীয় উদ্যান, ব্যাঘ্র প্রকল্প ও বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এই বনের ইতিহাসও খুব প্রাচীন। ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে সুন্দরবনের স্বত্ত্বাধিকার নিয়ে, এর মানচিত্র তৈরি করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে, এই বনের আয়তন ছিল প্রায় দ্বিগুন। ১৮২৯ সালে সার্ভে অফিসার এল.টি .হজেস সাহেবের জরিপে এই তথ্য জানা যায়। পরের বছর, ড্যাম্পিয়ার এবং হজেস, এই দুই সার্ভে অফিসার সুন্দরবনের বদ্বীপ অঞ্চলের উত্তর সীমা নির্ধারণ করেন। তাঁদের নাম অনুসারে, এই রেখার নাম রাখা হয়। সুন্দরবনের প্রথম বিভাগীয় বনকর্তার নাম এস.ইউ.গ্রিন। ১৯৭০ সালে ভারতীয় বনের অংশ ব্যাঘ্র প্রকল্প হিসাবে ঘোষিত হয়। অভয়ারণ্যের মর্যাদা পায় ১৯৭৭ সালে। তারপর ১৯৮৪ সালে জাতীয় উদ্যান, ১৯৮৭ সালে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী বন এবং ১৯৮৯ সালে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসাবে ঘোষিত হয়। অসংখ্য নদী–‌নালা বেষ্টিত সুন্দরবনে, বঙ্গোপসাগরের ৭.৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত জোয়ার, অধিকাংশ সময় দেখতে পাওয়া যায়। আমারও সে অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার। পরে, সুযোগ পেলে সে কাহিনি আপনাদের জানাব। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ছোট বড় প্রায় দুশো বদ্বীপ। বন সংলগ্ন মাত্র চুয়ান্নটা দ্বীপে মানুষের বাস। বৈদ্যুতিক আলো, রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য কোনওটাই নেই অধিকাংশ দ্বীপে। শুধু কৃষি আর নদীর মাছ সংগ্রহ, এই ছিল জীবিকা। তুলনায়, অবৈধ উপায়ে বেঁচে থাকার সহজ পন্থাকে বেছে নিয়েছিল তারা।

সে সময় সুন্দরবনকে ঘিরে অপরাধ দিন দিন বাড়ছিল। কাঠ পাচার, চোরা শিকার, অবৈধ উপায়ে মধু, মাছ ও কাঁকড়া সংগ্রহ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এ ছাড়াও মাঝে মধ্যে হরিণের মাংস বিক্রি, বাঘের চামড়া বিক্রির ঘটনাও শোনা যাচ্ছিল। আর বনদপ্তরের পারমিশন নিয়ে যাঁরা বনের গভীরে মাছ, কাঁকড়া, কাঠ, মধু ইত্যাদি সংগ্রহে যেতেন, তাঁদের জলদস্যুদের মোকাবিলা করতে হত। জেলে বা মওলিদের আটকে রেখে পণ আদায় করা, সঙ্গের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়া, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হত, এই নৃশংস জলদস্যুদের হাতে। তবু, বেঁচে থাকার তাগিদে, প্রাণ হাতে নিয়েও বন সংলগ্ন গ্রামের বেশ কিছু মানুষ, এই কাজে লিপ্ত ছিলেন।
বন দপ্তর এই সহজ সত্যিটা বুঝেছিল যে, শুধুমাত্র বনকর্মীদের দিয়ে এই সুবিশাল বনকে বাঁচানো সম্ভব নয়। বন পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষকে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে, তবেই বন বাঁচানো সম্ভব। তাই, গ্রামের মানুষদের নিয়ে তৈরি হল ই.ডি.সি বা ইকো ডেভলপমেন্ট কমিটি। ধীরে ধীরে অধিকাংশ গ্রামবাসী এর আওতায় এলেও, চোরাগোপ্তা অপরাধ লেগেই ছিল। বন বাঁচলে, গ্রাম বাঁচবে এই সহজ সত্যিটা বুঝলেও, অপরাধ ঠেকানো যাচ্ছিল না। আর বাড়ছিল, বনের গভীরে পারমিট নিয়ে যাওয়া জেলে, মউলিদের ওপর জলদস্যুদের আক্রমণ। এরা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, অনেক সময় বনের পাশের গ্রামে হামলা করত, ফসল লুঠ করে গভীর জঙ্গলে গা ঢাকা দিত। পুলিশ কিম্বা বন দপ্তর ওদের টিকিও খুঁজে পেত না। মূলস্রোত কাগজ বা চ্যানেলে এসব ঘটনা সেভাবে উঠেও আসত না। এখনও এইসব ভয়ঙ্কর ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।

বাচ্চু সর্দার এর নাম আমি প্রথম শুনি দয়াপুরে। তারপর শান্তিগাছি, কুমীরমারি যেখানেই গেছি, প্রায় সবাই ওর নাম করেছেন খুব সাবধানে, ভয়ে ভয়ে। সুন্দরবনের এক সময়কার ভয়ঙ্কর জলদস্যু বাচ্চু। ওকে ঘিরে সুন্দরবনের আনাচে কানাচে কত মিথ, কত গল্প ছড়িয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। বাদাবনের বেতাজ বাদশা। পুলিশের হাতে কখনও ধরা পড়েনি। বন দপ্তরও ওর হদিশ পায়নি। বাচ্চুর বাড়ি ঝড়খালিতে, এটা ছাড়া আর কোনও ইনফর্মেশন জোগাড় করতে পারিনি। তখন বাচ্চু সর্দারকে ভয় পায় না, এমন মানুষ গোটা সুন্দরবনে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। আরও কিছু ইনফর্মেশনের তাগিদে, যখনই সবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি, হয় সবাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন, না হয় অতি সাবধানে তার গুণগান করেছেন।

ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক, এই বাচ্চু সর্দারকে খুঁজে বের করতেই হবে। তার ইন্টারভিউ নিতেই হবে। চিরকাল ক্রাইম নিয়ে কাজ করছি। চোর–‌ডাকাত, গুন্ডা–‌বদমাশ তো কম দেখিনি, এবার না হয় জ্যান্ত জলদস্যু দেখব। অফিস থেকে পারমিশন পেয়ে, চললাম ঝড়খালিতে।

jaladasyu5

বাচ্চুর বাড়ি ঝড়খালির নবাবগঞ্জের গরাণবোস গ্রামে। একসময় জনমজুরি আর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা ছাপোষা বাচ্চু, হঠাৎ এমন ভয়ঙ্কর জলদস্যু হয়ে উঠল কেন, প্রশ্নটা মনের মধ্যে কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঝড়খালিতে রবিনহুড ইমেজ ওর। তাই ইতিউতি জিজ্ঞাসা করেও কোনও সুরাহা হচ্ছিল না। ঠিক করলাম, সোজা যাব বাচ্চুর বাড়িতে। তারপর যা হওয়ার হবে। কিন্তু বাড়িতে গেলেই কি আর ওকে পাওয়া যাবে? সে তো এত সুবোধ বালক নয়। সফর সঙ্গী ফটোগ্রাফারের মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারছি। মনে মনে নির্ঘাত আমাকে গাল পাড়ছে আর বলছে, কী দরকার ছিল এই ইন্টারভিউর।

ভ্যান রিক্সায় নবাবগঞ্জ তো পৌঁছলাম, এবার গরাণবোস গ্রামে যাই কী করে? একটা চায়ের দোকানে কিছু মানুষ জন ছিলেন। চা খেলাম, ওদের জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু ওঁরা কেউই বাচ্চুর বাড়ির ঠিকানা বলতে পারলেন না। আমার মন বলছে, ওঁরা সবাই জানেন, তবুও বলবেন না। বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন, আমরা কারা, কোথা থেকে আসছি ইত্যাদি। সাংবাদিক মন কিন্তু অন্য কথা বলছে। ওঁরা আমাকে বাচ্চুর কোনও কথা বলেননি, এটা ঠিক, কিন্তু আমাদের সম্পর্কে সব কথাই যে বাচ্চুর কানে পৌঁছবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কাছেই বামফ্রন্টের (আর.এস.পি) একটা মিটিং চলছে, সেখানে গেলে হয়ত একটা সুরাহা হতে পারে, এটা ভেবে মিটিং স্থলে গেলাম। কান্তিবাবুকে ফোন করলাম। উনি স্থানীয় এক নেতাকে বললেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এতদিন পর সেই নেতার নাম আজ আর মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, বাচ্চু সর্দারের বাড়ি যাব শুনে, তিনিও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। অন্য কেউ হলে হয়তো তিনিও এড়িয়ে যেতেন, কিন্তু মন্ত্রীর নির্দেশ, তাই ফেলতে পারেননি। শেষে তার সহযোগিতায় একটা নৌকা ভাড়া করে, বিদ্যাধরী নদী ধরে কানমারি খালে এসে পড়লাম। এই খাল বয়ে গেছে গরাণবোস গ্রামের পাশ দিয়ে। বাচ্চুর পৈতৃক ভিটে এখানেই। এক হাঁটু কাদা ঠেলে কোনও মতে বাচ্চুর বাড়ির সামনে যখন দাঁড়ালাম, ঘড়িতে তখন দুপুর একটা। নাম ধরে ডাকতেই, এক মাঝ বয়সী মহিলার স্পষ্ট জবাব, বাড়ি নেই, কোথায় গেছে, কবে আসবে জানি না। কী আর করব, ফিরে চললাম। অবশ্য, এটা জানাই ছিল যে, বাচ্চুকে বাড়িতে পাব না। বাড়ির ছবিটা তো পাওয়া গেল।

ফেরার সময় আবার সেই নবাবগঞ্জের চায়ের দোকান। খিদের জ্বালায় পেটাই পরোটা আর ঘুঘনি গোগ্রাসে গিলছি, হঠাৎ–‌ই চার পাঁচটা ভ্যান রিক্সায় প্রায় ২০–‌২৫ জন লোক চায়ের দোকানে এসে থামল। রীতিমতো ধমকের সুরে বাজখাঁই গলায় একজন জানতে চাইল, ‘‌কী ব্যাপার, কে আমার খোঁজ করছে?’‌ চা দোকানী আমাকে দেখিয়ে নিচুস্বরে কিছু বলতেই লোকটা আমার দিকে সরাসরি আসতে লাগল। চায়ের দোকানের ভেতরটায় আলো কম, তবু ক্যামেরা ম্যানকে বলা ছিল, কোন সিচুয়েশ্যন মিস করা যাবে না। ওকে ইশারা করে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

আমি কিছু বলার আগেই, বাচ্চুর নির্দেশ, বাইরে আসুন। রাস্তার ওপারে অনেকটা খালি জায়গা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ক্যামেরা চলছে। আমি ভাল করে বাচ্চুর দিকে তাকালাম। লম্বায় সাড়ে পাঁচফুট হবে, গায়ের রং বেজায় কালো, তবে চোখ দুটো মারাত্মক লাল। গায়ে নস্যি রঙের ফতুয়া আর চেক লুঙ্গি। কাছে যেতেই হাড়িয়ার গন্ধ নাকে এল। জবা ফুলের মতো লাল চোখের কারণ বুঝতে পারলাম। শুধু ও নয়, ওর সঙ্গীরাও এই ভরদুপুরে এক পেট হাড়িয়া টেনে বসে আছে। আমি কলকাতা থেকে আসা নিরীহ এক সাংবাদিক জেনে, ও নিজে আশ্বস্ত হল। সঙ্গীদের একটু তফাতে যেতে বলল। বুঝলাম, ঝামেলা হতে পারে এই আশঙ্কায় রীতিমতো তৈরি হয়ে এসেছে বাচ্চু। কে জানে, কে ওর কান ভারি করল?

‘‌বলুন, কী জানতে চান’‌–‌ বাচ্চুর সরাসরি প্রশ্ন আমার দিকে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, হাড়িয়ার প্রভাবে ও টলছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‌জলদস্যুর জীবন ভাল লাগছে?’‌ কিছু সময় চুপ করে, বাচ্চু বলল, ‘‌না লেগে আর উপায় কোথায়?’‌ তারপর আমাকে আর প্রশ্ন করতে হয়নি। ও নিজেই বলতে শুরু করল, ওর ফেলে আসা অতীত জীবনের কথা। কানমারির খাল ধরে, বিদ্যাধরী নদী বেয়ে বাচ্চু আর তার দলবল কত যে নিরীহ, অসহায় মানুষকে নিঃস্ব করেছে, তার ইয়ত্বা নেই। লুঠতরাজ, পণবন্দি, ডাকাতি, মানুষ খুন, কী করেনি এরা? এত অপরাধ করার পরেও, এরা কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, কে জানে? পুলিশের খাতায়, বাচ্চু ও তার দলবল তখনও ফেরার। অথচ, প্রকাশ্য দিবালোকে শুধু ঝড়খালি নয়, গোটা সুন্দরবন অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বাচ্চু সর্দার ও তার দলবল। তবে, এ অঞ্চলের কোনও গরীব মানুষের জন্য বাচ্চুর দরজা খোলা। বাচ্চুর কাছে যে কেউ সাহায্য চাইলে পায়। সে কারণেই হয়ত, বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনও কথা কেউ জানলেও বলে না। একসময় অভাবের তাড়নায় ডাকাতির জীবন বেছে নিয়েছিল ও। এখন যথেষ্ঠ স্বচ্ছল অবস্থা। তিনটে বিয়ে। বড় বউ থাকে গরাণবোস গ্রামে, যাকে ইতিমধ্যেই আমরা দেখে এসেছি। মেঝ বউ এর সঙ্গে ত্রিদিবনগরে থাকে বাচ্চু। আর, ছোট বউ থাকে সন্দেশখালিতে। দুটি মেয়ে আর চার ছেলে, মোট ছয় ছেলেমেয়ে বাচ্চুর। আমার শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘‌এই অপরাধের জীবন কবে ছাড়বে?’‌ কোনও জড়তা না রেখে স্পষ্ট জানাল, ‘‌অভ্যাস আর দল চালানোর তাগিদ যে দিন মিটে যাবে, সে দিন।’‌ বুঝলাম, স্বাভাবিক জীবনে আর কোনওদিনই ফিরতে পারবে না, সুন্দরবনের হাড় হিম করা জলদস্যুদের সর্দার।

বেলা শেষ হয়ে আসছিল। ওর দলের লোকেরাই একটা ভ্যান–‌রিক্সা ঠিক করে দিল। আমরা ফিরে যাব ঝড়খালি হয়ে গোসাবায়। বাচ্চু নাত নেড়ে বিদায় জানাল। সত্যি বলতে কী, সুন্দরবনের ত্রাস, একজন জলদস্যুকে হাত নেড়ে বিদায় জানাব, এটা ভেবে মন একটু দ্বিধায় ছিল, শেষে আমিও হাত নেড়ে বাচ্চুকে বিদায় জানালাম। রাত আটটায় গোসাবা পৌঁছলাম। পরদিন ফিরে এলাম কলকাতায়।‌‌

(বেঙ্গল টাইমসে মাঝে মাঝেই এমন আকর্ষণীয় ফিচার প্রকাশিত হয়। উঠে আসে নানা অজানা দিক। এমন অভিজ্ঞতা থাকলে আপনিও পাঠিয়ে দিন বেঙ্গল টাইমসের ঠিকানায়। সঙ্গে ছবিও পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা bengaltimes.in@gmail.com)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.